সুদীপ নাথ
(রাজ্যের প্রথম গ্রিন জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত )
আগরতলা, ২০ডিসেম্বর : রাজ্যের পশ্চিম জেলার অন্তর্গত মোহনপুর আর ডি ব্লক এলাকার বাসিন্দা তুলসী রুদ্রপাল নিজের অজান্তেই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। তিনি তার ব্যবসার কথা চিন্তা করে এই কাজ শুরু করলেও মানুষের অজান্তে নিরবেই তিনি জনসাস্থ্যের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন ইতিমধ্য। তিনি পেশায় মৃৎশিল্পী। মাটির অন্যান্য সকল প্রচলিত মাটির জিনিসপত্রের পাশাপাশি প্রেসার কুকার জলের বোতল থেকে শুরু করে আরও অনেক জিনিস মাটি দিয়ে তৈরি করছেন। যেগুলো মূলত বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর তৈরি হয়ে থাকে। তার এই মাটির জিনিস গুলো দেখে শখের বসে মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন সেই সঙ্গে নিজেরাই স্বাস্থ্য রক্ষার দিকে এক কদম এগিয়ে যাচ্ছেন। এই কাজে ত্রিপুরা গ্রামীণ জীবিকা মিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তাদের অনুপ্রেরণায় মাটির বাসনপত্র তৈরীর কাজ শুরু করেছেন শ্রীমতি রুদ্রপাল। সরস মেলার থিম প্যাভিলিয়নে অন্য সকল সামগ্রী সঙ্গে তুলসী রুদ্রপালের তৈরি রাখা রয়েছে। এগুলো নিয়ে মানুষের আগ্রহ থেকে সহজেই বুঝা যায় এর চাহিদা ব্যাপক রয়েছে। তাই এখন আমাদের সকলের উচিত ব্যাপক অংশের জনগণের স্বাস্থ্যের বিষয়টি চিন্তা করে নিজেরা এই ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করা এবং মানুষদের মধ্যে আরও ব্যাপক হারে প্রচার করা। সেই সঙ্গে গ্রামীণ জীবিকা মিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে রাজ্যের যে সকল স্ব-সহায়ক দল মাটির কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা যেন গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত বাসনপত্র তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তুলসী রুদ্রপালের এই উদ্যোগ নিয়ে রাজ্যের আগে কখনো খবর হয়েছে কিনা আমি জানি না, অন্তত আমার নজরে আসেনি। আমিও এই বিষয়ে জানতাম না গ্রামীণ জীবিকা মিশনের পশ্চিম জেলা অফিসের সুচিস্মিতা রুদ্রপাল, একপ্রকার জোড় করেই আমাকে বলে দাদা, তুলসী দিদি ভালো কাজ করছেন আপনি অবশ্যই একবার গিয়ে দেখে আসুন। সুচিস্মিতার কথা শুনে আমি তুলসী রুদ্রপালের হরিনাখলার বাড়িতে যাই, গিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখে আমি সত্যি অবাক হই।
চলুন এবার জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি ভারতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার এবং এই ধাতু ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কেমন। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ চীন। বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫০ থেকে ৬০শতাংশ বা তারও বেশি অ্যালুমিনিয়াম একাই চীন উৎপাদন করে। চীনের বার্ষিক প্রাথমিক অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদন প্রায় ৪১–৪৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
এর পরেই রাশিয়া, কানাডা ইত্যাদি দেশ আসে। ভারত নিজেও একটি এলুমিনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ তারপরও অ্যালুমিনিয়াম আমদানি করতে হয় চাহিদা পূরণের জন্য। ভারত অনেক রকম আলাদা ধরনের অ্যালুমিনিয়াম পণ্য আমদানি করে। যেমন অ্যালুমিনিয়াম স্ক্র্যাপ, আনওরাইট/আলয়েড অ্যালুমিনিয়াম, ইত্যাদি)। মালয়েশিয়া, কাতার, বাহরাইন ইত্যাদি দেশ থেকে ভারতের আলুমিনিয়াম আনওরাইট/আলয়েড আমদানি সর্বোচ্চ। ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, রাশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ থেকেও কম পরিমাণে আসে। এছাড়া অ্যালুমিনিয়াম স্ক্র্যাপ আমদানি হয় চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ইত্যাদি থেকেও। ২০২৪ সালের হিসাবে অনুসারে ভারতের অ্যালুমিনিয়াম আমদানির পরিমান ছিল প্রায় কয়েক মিলিয়ন মেট্রিক টন, টাকার অঙ্কে প্রায় ৭.৭ বিলিয়ন ডলার।
এই বিশাল পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহারের পাশাপাশি গৃহস্থালী বাসন তৈরীর কাজেও ব্যবহার করা হয়। কারন আমাদের রান্নাঘরের সামগ্রীগুলির মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই ধাতু। নিত্যদিন ব্যবহার করা হলেও গবেষকরা বলছেন অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে রান্না করা খাবারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে প্রচন্ড রকম। অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে খাবার রান্না কি কি স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে এই বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নানা সময় লেখালেখি হয়েছে। এর কিছু নিম্ন রূপ।
সিল বেরিয়ে আসা ও ধাতু খাদ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া
গবেষণায় দেখা গেছে অ্যালুমিনিয়াম পাত্র থেকে রান্নার সময় ধাতু খাদ্যের ভেতরে লিক (leach) হতে পারে — বিশেষ করে তিতা / অ্যাসিডিক খাবারে। এতে শরীরে অ্যালুমিনিয়ামসহ অন্যান্য ভারী ধাতুর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে যা স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
📌 সূত্র: PubMed-ভিত্তিক বিজ্ঞান গবেষণা রিপোর্ট
অ্যালুমিনিয়াম এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য
কিছু সংবাদ মার্কেট যেমন Times of India উল্লেখ করেছে যে ‘অ্যালুমিনিয়ামের মাত্রা মস্তিষ্কের টিস্যুতে বেশি থাকলে আলঝাইমার ডিমেনশিয়া, মাথাব্যথা বা অন্যান্য সমস্যা হওয়ার আশंका আছে’— যদিও এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত মানবিক প্রমাণ এখনও সীমিত।
📌 সূত্র: The Times of India
কিডনি ও অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি
কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে যে অতিরিক্ত অ্যালুমিনিয়াম শরীরে জমে গেলে কিডনি রোগ, টক্সিসিটি ইত্যাদি ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
📌 সূত্র: The Times of India
সীসা মিল থাকার ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA) সতর্ক করেছে যে ঠিক মতো মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তৈরি কিছু অ্যালুমিনিয়াম/অ্যালয় বাসনে রান্না করলে সীসা (Lead) খাদ্যের মধ্যে মেশাতে পারে, যা বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
📌 সূত্র: U.S. FDA warning reported in Tom’s Guide / FDA news
উপরের স্বাস্থ্যঝিকির বিষয়গুলো চিন্তা করে সচেতন ভাবে আমাদের অ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী যতোটুকু কম সম্ভব ব্যবহার করার চেষ্টা করা উচিত। আগে একটা সময় ছিল যখন মাটির বাসনপত্রের রান্না করা হতো কিন্তু আধুনিকতা ও লোক দেখানো আভিজাত্যের কারণে আমাদের রান্নাঘর থেকে সরে গিয়েছে মাটির বাসন এবং স্থান করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল এর আস্তরণ দেওয়া বাসন। আমি ব্যক্তিগতভাবেও দেখেছি ঠাম্মা এবং দিদারা মাটির বাসনপত্র নানা সময় রান্নাবান্না করতেন তখনও আমাদের ঘরে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র ছিল। তাদের যুক্তি ছিল মাটির বাসনপত্রে রান্না করা তরি তরকারির স্বাদ অনেক বেশি হয়।
0 মন্তব্যসমূহ