শীত এলেই আমাদের জলাভূমি, হাওর-বাঁওড়, নদীর চর ও খোলা মাঠে ভিড় করে অচেনা অতিথিরা। এরা পরিযায়ী পাখি—যারা ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছুটে আসে। প্রকৃতির এই নিয়মিত অভিবাসন শুধু সৌন্দর্যই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ।
কোন ঠান্ডা দেশ থেকে আসে পরিযায়ী পাখিরা
পরিযায়ী পাখিরা মূলত পৃথিবীর উচ্চ অক্ষাংশের ঠান্ডা অঞ্চল থেকে আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
উত্তর ইউরোপ (স্ক্যান্ডিনেভিয়া, রাশিয়ার উত্তরাংশ)
সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়া
উত্তর আমেরিকার কানাডা ও আলাস্কা অঞ্চল
উত্তর এশিয়ার আর্কটিক উপকূল
এই সব অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা অত্যন্ত কমে যায়, জলাশয় বরফে ঢেকে যায় এবং খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। তাই টিকে থাকার জন্য পাখিরা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলের পথে পাড়ি জমায়।
কোন কোন মহাদেশে যায়
শীতের সময় পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত—
এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়
ইউরোপ থেকে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়
উত্তর আমেরিকা থেকে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়
উত্তর এশিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শীতকালীন আবাসস্থল।
কখন যাত্রা শুরু করে
পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত—
শীত অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে: সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নভেম্বরের মধ্যে
ফিরে যায়: ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে
দিন ছোট হওয়া, তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং খাদ্যের ঘাটতি—এই সংকেতগুলোই তাদের যাত্রার সময় নির্ধারণ করে।
যাত্রাপথে কতদিন সময় লাগে
পাখির প্রজাতি ও পথভেদে যাত্রার সময় ভিন্ন হয়—
কেউ কয়েক দিন টানা উড়ে আসে
কেউ ২–৬ সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে আসে
অনেক পাখি পথে পথে জলাভূমি ও উপকূলে বিশ্রাম ও খাদ্য সংগ্রহ করে
কিছু প্রজাতি দিনে শত শত কিলোমিটার উড়তে সক্ষম।
ডিম পাড়া, বাসা তৈরি ও বাচ্চা ফোটানো
পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত শীতকালীন আশ্রয়স্থলে ডিম পাড়ে না। তারা—
বসন্তকালে নিজেদের আদি ঠান্ডা অঞ্চলে ফিরে যায়
সেখানেই বাসা তৈরি করে
ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ফোটায়
কারণ ঠান্ডা অঞ্চলের গ্রীষ্মকালে দিন বড় হয়, খাদ্য প্রাচুর্য থাকে এবং বাচ্চা লালন-পালনের জন্য পরিবেশ অনুকূল থাকে।
কোন কোন জাতের পাখি এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যায়
শীতকালে যে সব পাখি মহাদেশ পাড়ি দেয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
হাঁস ও রাজহাঁস (Bar-headed Goose, Northern Pintail), চখাচখি ও গাংচিল জাতীয় পাখি, বালিহাঁস ও জলচর পাখি (Common Teal, Gadwall), স্যান্ডপাইপার ও প্লোভার, সাইবেরিয়ান ক্রেন, ফ্ল্যামিঙ্গো
আর্কটিক টার্ন (সবচেয়ে দীর্ঘ দূরত্বে যাতায়াতকারী পাখিদের একটি)
এদের অনেকেই হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকায় শীত কাটায়।
পরিযায়ী পাখি ও আমাদের দায়িত্ব
পরিযায়ী পাখিরা পরিবেশের স্বাস্থ্য নির্দেশক। জলাভূমি ধ্বংস, দূষণ ও অবৈধ শিকার তাদের জন্য বড় হুমকি। নিরাপদ আবাসস্থল ও খাদ্য নিশ্চিত করতে পারলে এই অতিথিরা প্রতি বছরই ফিরে আসবে।
পরিযায়ী পাখির শীতকালীন যাত্রা প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। ডানায় ভর করে তারা শুধু দেশ-মহাদেশ নয়, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ককেও জুড়ে দেয়। এই শীতে তাদের আগমন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতি বাঁচলে, আমরাও বাঁচব।
0 মন্তব্যসমূহ