Advertisement

Responsive Advertisement

আরাবল্লী বাঁচাও, উত্তর ভারত বাঁচাও — প্রাচীন পাহাড় ঘিরে ভবিষ্যতের লড়াই



              পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী সুমন পাল

আগরতলা, ২৩ ডিসেম্বর : আরাবল্লী শুধু ভারতের প্রাচীনতম পর্বতমালা নয়- এটি উত্তর ভারতের বায়ু, জল, জলবায়ু ও সভ্যতার নীরব প্রহরী।
আইনের সংজ্ঞা বদলানো যায়, কিন্তু পাহাড় ভেঙে গেলে বৃষ্টি, বাতাস আর জল আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
আরাবল্লী বাঁচানো মানে—উত্তর ভারতের ভবিষ্যৎ বাঁচানো।

আরাবল্লী পর্বতমালা—পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পর্বতশ্রেণি—আজ ভারতের পরিবেশগত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট যখন আরাবল্লী পাহাড়ের জন্য একটি একক বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা গ্রহণ করে, তখন সেটি শুধু আইনি ব্যাখ্যা ছিল না। এটি উত্তর ভারতের বায়ু, জল, জীববৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে একটি জাতীয় আলোচনার সূচনা করে।

ইতিহাসেরও আগের এক পাহাড়
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, আরাবল্লী পর্বতমালার বয়স প্রায় ২০০ কোটি বছর। প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগে গঠিত এই পাহাড়শ্রেণি আজ গুজরাট থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
দিকনির্দেশনা: দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব
অন্তর্ভুক্ত রাজ্য: গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি-এনসিআর
সর্বোচ্চ শৃঙ্গ: গুরু শিখর (১,৭২২ মিটার), মাউন্ট আবু
আজকের আরাবল্লী একসময়ের বিশাল পর্বতশ্রেণির ক্ষয়প্রাপ্ত অবশেষ হলেও এর পরিবেশগত ভূমিকা এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কেন আরাবল্লী আজ আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে—
“আরাবল্লী কেবল একটি পাহাড় নয়, এটি উত্তর ভারতের প্রাকৃতিক জীবনরক্ষা ব্যবস্থা।”

এই পাহাড়—
থর মরুভূমির পূর্বমুখী বিস্তার রোধ করে।
ধুলিঝড় ও বায়ুদূষণ কমায়।
ভূগর্ভস্থ জল পুনর্ভরণ ও জলাধার সুরক্ষা করে।
জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে।
দিল্লি-এনসিআরের বায়ু মান থেকে শুরু করে রাজস্থানের জল নিরাপত্তা—সবকিছুর সঙ্গেই আরাবল্লী অদৃশ্যভাবে জড়িত।

সুপ্রিম কোর্টের রায়: ২০২৫ সালে কী বদলাল ?

সুপ্রিম কোর্ট একটি বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা গ্রহণ করে—
আরাবল্লী পাহাড়:
স্থানীয় ভূমি থেকে ১০০ মিটার বা তার বেশি উঁচু ভূমিরূপ।
আরাবল্লী পর্বতমালা:
৫০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত দুই বা ততোধিক পাহাড়ের সমষ্টি।
মাঝের ঢাল, উপত্যকা ও ছোট পাহাড়—সবই পর্বতমালার অংশ।
মূল নির্দেশনা—
টেকসই খননের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা না হওয়া পর্যন্ত নতুন খনন ইজারা বন্ধ ।
মূল ও অক্ষত অঞ্চলে খনন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।
আইসিএফআরই-এর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক মানচিত্রায়ণ ও ধারণক্ষমতা নির্ধারণ ।

আদালত আরও জানায়—সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা অবৈধ খনন বাড়াতে পারে, তাই নিয়ন্ত্রিত ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

সরকারের অবস্থান 
কেন্দ্র সরকার জানিয়েছে— এই রায়ে পরিবেশ সুরক্ষা দুর্বল হয়নি ।
অবৈধ খননই আসল বিপদ ।
ড্রোন, উপগ্রহ নজরদারি ও প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টও স্পষ্ট করেছে—পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল অবশ্যই সুরক্ষিত থাকবে।

তবুও কেন উদ্বেগ বাড়ছে ? 

পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছেন।
ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন অনুযায়ী, ১০০ মিটার সীমা আরোপ করলে আরাবল্লী এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ বাদ পড়তে পারে।
মূল আশঙ্কাগুলি—
নিচু পাহাড়, ঢাল ও উপত্যকাও পরিবেশগত ধারাবাহিকতার অংশ
শহরতলি অঞ্চলে খননের চাপ বাড়তে পারে
ভূগর্ভস্থ জল পুনর্ভরণ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্থায়ী জল সংকট ।

আরাবল্লীর প্রাকৃতিক প্রাচীর দুর্বল হলে থর মরুভূমি পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে ।
দিল্লি-এনসিআরের দূষণ সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

উত্তর ভারতে প্রতিবাদ এই আশঙ্কাই জনআন্দোলনের সূত্রপাত করেছে।

প্রতিবাদের বিস্তার— রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি-এনসিআর, গুজরাট
প্রধান কেন্দ্র— গুরুগ্রাম–ফরিদাবাদ অঞ্চল, জয়পুর, আলওয়ার, দক্ষিণ দিল্লি ।

প্রতিবাদের রূপ—
শান্তিপূর্ণ মিছিল
নাগরিক উদ্যোগ
পরিবেশ সংগঠন, ছাত্র ও অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ
সামাজিক মাধ্যমে আন্দোলন: #SaveAravalli

আরাবল্লী: খনন, জনসংখ্যা ও নির্মাণের চাপ আরাবল্লীর অবক্ষয় কোনো একক সরকারের ফল নয়; এটি কয়েক দশকের জমে ওঠা চাপের পরিণতি।
২০০৪–২০১৪ সালে ব্যাপক আইনি ও অবৈধ খননের ফলে পাহাড় ক্ষয়, ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস ও বনভূমি বিভাজন ঘটে, যার প্রতিফলন ২০০৯ সালের খনন নিষেধাজ্ঞায় দেখা যায়।
২০১৪ সালের পর নতুন খনন ইজারা কমলেও গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদ ও জয়পুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ—রিয়েল এস্টেট, রাস্তা ও শিল্পাঞ্চল—আজ সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্পষ্ট সত্য হলো—খননের চেয়েও জনসংখ্যা ও নির্মাণজনিত ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন বর্তমানে আরাবল্লীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
একটাই স্লোগান বারবার উঠছে—
“আরাবল্লী বাঁচাও, উত্তর ভারত বাঁচাও।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ