Advertisement

Responsive Advertisement

অদৃশ্য মানুষ, জীবন্ত লাশ আর নিষিদ্ধ মন্ত্র—কালা জাদুর দেশ মায়াং

 ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে এক বিস্ময়কর জনপদ—মায়াং। লোকমুখে যার পরিচয় ‘কালা জাদুর দেশ’ হিসেবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের নাম জড়িয়ে আছে তন্ত্র-মন্ত্র, জাদু-টোনা আর অলৌকিক ক্ষমতার গল্পের সঙ্গে। বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা যেখানে বারবার মিলিয়ে যায়, সেই জায়গাটিই মায়াং।

মায়াং কোথায়?
মায়াং অবস্থিত আসামের মরিগাঁও জেলায়। একসময় ঘন জঙ্গলে ঘেরা এই এলাকা আজও তার রহস্যময় চরিত্র পুরোপুরি হারায়নি। আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও মায়াংয়ের অতীত এখনও মানুষের কৌতূহল জাগিয়ে রাখে।
গৌহাটি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াং কোনো সাধারণ গ্রাম নয়। আসামের মরিগাঁও জেলার এই জনপদ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিচিত এক অদ্ভুত নামে—কালা জাদুর দেশ। এখানে ইতিহাস আর কিংবদন্তি এতটাই জড়িয়ে গেছে যে কোনটা সত্য, আর কোনটা কেবল লোককথা—তা আলাদা করা কঠিন।
দিনের আলোয় মায়াং আর পাঁচটা গ্রামের মতোই। কিন্তু সূর্য ডুবলেই এই এলাকার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আতঙ্ক যেন নতুন করে জেগে ওঠে। প্রবীণদের চোখে আজও ভেসে ওঠে সেই সময়, যখন মায়াং মানেই ছিল ভয়, নিষিদ্ধ জ্ঞান আর অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি।

ভয় জন্মানোর ইতিহাস
মায়াংয়ের কালা জাদুর ইতিহাস অন্তত কয়েক শতাব্দী পুরোনো। শোনা যায়, এক সময় এখানে এমন সব তান্ত্রিক বাস করতেন, যাঁরা মানুষের শরীর ও মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। মন্ত্রের মাধ্যমে কাউকে অসুস্থ করা, কাউকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেওয়া, এমনকি স্মৃতিভ্রংশ ঘটানোর গল্প ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
লোকমুখে প্রচলিত আছে, রাতের বেলায় মায়াংয়ের পথে হাঁটলে হঠাৎ কেউ নিজের পরিচিত মানুষকে দেখতে পেত—কিন্তু কাছে গেলেই সে মিলিয়ে যেত। এই ঘটনাকেই বলা হতো “মায়াং-এর ডাক”।

অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষ
সবচেয়ে ভয়ংকর গল্পগুলোর একটি হলো মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। বিশ্বাস করা হতো, তান্ত্রিকরা বিশেষ মন্ত্র পড়ে মানুষের ইন্দ্রিয় বিভ্রান্ত করে দিতেন। আক্রান্ত ব্যক্তি জীবিত থাকলেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত—না কথা বলতে পারত, না পথ চিনতে পারত। লোকেরা একে বলত “জীবন্ত লাশ”।

তন্ত্র, যন্ত্র আর নিষিদ্ধ সাধনা
মায়াংয়ের কালা জাদুর মূল ছিল তন্ত্রসাধনা। নির্দিষ্ট তিথি, চন্দ্র অবস্থান আর সময় বেছে নিয়ে সাধনা করা হতো। শ্মশান, বন আর নদীর ধারে বসেই তৈরি হতো যন্ত্র। এই যন্ত্রের উপর বসে উচ্চারণ করা হতো গোপন মন্ত্র।
এই মন্ত্র কখনোই সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছাত না। গুরু থেকে শিষ্যে কেবল মৌখিকভাবে তা হস্তান্তর করা হতো। অনেক তান্ত্রিক মৃত্যুর আগে নিজের জ্ঞান কবরেই নিয়ে যেতেন—যাতে মন্ত্র অপব্যবহার না হয়।
লিখিত প্রমাণ: মায়াং সেন্ট্রাল মিউজিয়াম
আজ মায়াংয়ের অতীতের প্রমাণ পাওয়া যায় মায়াং সেন্ট্রাল মিউজিয়াম অ্যান্ড এমপোরিয়াম-এ। সেখানে সংরক্ষিত আছে—
শতাব্দীপ্রাচীন তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপি, তাবিজ, কবচ ও ধাতব যন্ত্র, লোকজ অস্ত্র ও চিকিৎসা সামগ্রী, তালপাতায় লেখা মন্ত্র। এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে যে মায়াংয়ের কালা জাদু কেবল ভয়ের গল্প ছিল না—এর পিছনে ছিল এক সুসংগঠিত জ্ঞানচর্চা।

চিকিৎসা না অভিশাপ?
মায়াংয়ের ওঝারা ছিলেন দক্ষ ভেষজ বিশেষজ্ঞ। তাঁরা গাছগাছড়া থেকে তৈরি করতেন এমন ওষুধ, যা আজও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সাপে কাটা, অজানা জ্বর, মানসিক অসুস্থতা—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের ডাক পড়ত।
কিন্তু ওষুধের প্রভাব, মন্ত্রের উচ্চারণ আর রোগীর ভয়—এই তিনে মিলে তৈরি হতো অলৌকিক অভিজ্ঞতা। ফলে চিকিৎসাই অনেক সময় অভিশাপ বলে মনে হতো।

বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ও অমীমাংসিত প্রশ্ন
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, মায়াংয়ের অনেক ঘটনা আসলে হিপনোসিস, সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন ও ভেষজ ওষুধের ফল। কিন্তু সব কিছুর ব্যাখ্যা আজও দেওয়া যায়নি। বহু ঘটনার কোনো লিখিত রেকর্ড নেই—আছে শুধু মানুষের স্মৃতি আর বিশ্বাস।

ভাঙছে ভয়ের দেওয়াল
আজকের মায়াং শিক্ষিত। নতুন প্রজন্ম কালা জাদুতে বিশ্বাস করে না। তান্ত্রিকদের প্রভাব কমেছে। তবু সন্ধ্যা নামলেই পুরনো গল্পগুলো ফিরে আসে। পর্যটকরা আসে রহস্যের খোঁজে, গবেষকরা আসে লোকসংস্কৃতির টানে।

মায়াং—এক জীবন্ত ইতিহাস
মায়াং আজ আর ভয়ের প্রতীক নয়, বরং লোকবিশ্বাস ও ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এটি আমাদের শেখায়—অজানার প্রতি মানুষের ভয়ই কখনও কখনও সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে ওঠে।
মায়াং—যেখানে এক সময় মন্ত্র সত্যি ছিল, আর মানুষ ভয় পেত নিজের ছায়াকেও।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ