Advertisement

Responsive Advertisement

পারমাণবিক বোমা,পাকিস্তান ও ভারতের অপারেশন সিন্দুর


                                           
                                           ড. হৈমন্তী ভট্টাচার্যী

পরমাণু অস্ত্র হলো এমন এক ধরনের ধ্বংসাত্মক যন্ত্র যা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার (ফিসান বা ফিউশন অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ) মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রচণ্ড শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে। এর ধ্বংস ক্ষমতা এতটাই বেশি যে একটি মাত্র বোমা দিয়েই একটি শহরকে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব।
পরমাণু অস্ত্রের প্রকারভেদ:
প্রধানত দুই ধরনের পরমাণু অস্ত্র রয়েছে:
 *পারমাণবিক বিদারণ বোমা (Nuclear Fission Bomb / Atomic Bomb)*: এই ধরনের বোমা পারমাণবিক বিদারণ (fission) বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। এক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়, যা বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করে। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে "*লিটল বয়*" ও "*ফ্যাট ম্যান*" বোমা ফেলা হয়েছিল, সেগুলো এই ধরনেরই ছিল।

 *থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা (Thermonuclear Bomb / Hydrogen Bomb):* এটি হাইড্রোজেন বোমা নামেও পরিচিত। এই বোমা বিদারণ এবং ফিউশন (fusion) উভয় বিক্রিয়া ব্যবহার করে। প্রথম ধাপে একটি বিদারণ বোমা দিয়ে প্রচণ্ড তাপ ও চাপ সৃষ্টি করা হয়, যা হাইড্রোজেন পরমাণুকে ফিউশন ঘটাতে বাধ্য করে এবং আরও বহুগুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন করে। হাইড্রোজেন বোমা পারমাণবিক বিদারণ বোমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

*পরমাণু অস্ত্রের বর্তমান অবস্থান*:
বর্তমানে বিশ্বের ৯টি দেশের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়:
 * মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
 * রাশিয়া
 * চীন
 * যুক্তরাজ্য
 * ফ্রান্স
 * ভারত
 * পাকিস্তান
 * ইসরায়েল (আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার বা অস্বীকার করে না)
 * উত্তর কোরিয়া
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৭০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজারে নেমে এসেছে। আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, যা বিশ্বের মোট অস্ত্রের ৯০% এর বেশি।
ভারত, পাকিস্তান এবং ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
পরমাণু অস্ত্র মানবজাতির জন্য এক বিরাট হুমকি এবং এর ব্যবহার আন্তর্জাতিক নীতিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পারমাণবিক বোমা প্রথম তৈরি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ (United States)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় "ম্যানহাটন প্রজেক্ট" (Manhattan Project) নামে একটি গোপন প্রকল্পের আওতায় তারা এটি তৈরি করে এবং ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই নিউ মেক্সিকোতে "ট্রিনিটি" (Trinity) নামক স্থানে এর প্রথম সফল পরীক্ষা চালায়। এরপর ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট জাপানের হিরোশিমা এবং ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে তারা দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে।
*পাকিস্তান* সাধারণত বায়ু-ভিত্তিক, ভূমি-ভিত্তিক এবং সম্ভাব্য সমুদ্র-ভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে। তাদের *পারমাণবিক অস্ত্রের ধরন এবং কিছু সম্ভাব্য অবস্থান:*
পারমাণবিক অস্ত্রের ধরন:
 *বিমান-ভিত্তিক:* পাকিস্তান মিরাজ III/V এবং F-16A/B যুদ্ধবিমানকে পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম হিসেবে পরিবর্তন করেছে বলে ধারণা করা হয়। তারা রা'আদ এবং রা'আদ-২ নামে বিমান-নিক্ষিপ্ত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে।
 *ভূমি-ভিত্তিক* *ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র:* পাকিস্তানের স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি তালিকা আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
   * আবদালি
   * গজনভি 
   * শাহীন-১ 
   * শাহীন-১এ 
   * শাহীন-২
   * শাহীন-৩ 
   * ঘোরি
   * নাসর 
   * আবাবিল - এটি মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেবল রিএন্ট্রি ভেহিকেল (MIRV) ক্ষমতা সম্পন্ন বলে মনে করা হয়।
 *ভূমি-ভিত্তিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র:* বাবর জিএলসিএম এবং বাবর-২/১(বি) জিএলসিএম তাদের ভূমি-ভিত্তিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম।
 *সমুদ্র-ভিত্তিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র:* পাকিস্তান বাবর-৩ এসএলসিএম নামে একটি সমুদ্র-ভিত্তিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উপর কাজ করছে বলে জানা গেছে। এটি সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য হবে বলে ধারণা করা হয়।
*পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাব্য অবস্থান:*
পারমাণবিক অস্ত্রের সঠিক অবস্থান অত্যন্ত গোপন রাখা হয়। তবে, কিছু সম্ভাব্য স্থান যেখানে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট স্থাপনা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলো হলো:
 *মাশরুর বিমান ঘাঁটি (Masroor Air Base):* এটি করাচির কাছে অবস্থিত এবং পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম মিরাজ যুদ্ধবিমান এখান থেকে পরিচালিত হয়।
 *সরগোদা ঘাঁটি (Sargodha Air Base/Garrison):* পাঞ্জাব প্রদেশের এই ঘাঁটি পাকিস্তানের কৌশলগত বাহিনী কমান্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে পারমাণবিক ও কৌশলগত অস্ত্র সংরক্ষণ ও ব্যবহার সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয় বলে মনে করা হয়। সরগোদা ওয়েপনস স্টোরেজ কমপ্লেক্সে পারমাণবিক গ্র্যাভিটি বোমা রাখা হতে পারে।
 *কামরা বিমান ঘাঁটি (Minhas (Kamra) Air Base):* এটি পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান বিমান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র। এখানেও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান মোতায়েনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
 *পানো আকিল গ্যারিসন (Pano Aqil Garrison):* এটি সিন্ধু প্রদেশের উত্তর অংশে ভারতীয় সীমান্ত থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট চিত্রে এখানে বাবর ও শাহীন-১ ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য বহু ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার (TEL) দেখা গেছে।
 *আক্রো গ্যারিসন (Akro Garrison):* এটি হায়দ্রাবাদের উত্তরে সিন্ধু প্রদেশের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। এখানে ক্ষেপণাস্ত্র টিইএল গ্যারেজ কমপ্লেক্সের নিচে একটি অনন্য ভূগর্ভস্থ সুবিধা রয়েছে।
 *ঘাজি খানের ডেরা (Dera Ghazi Khan):* এটিও একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক স্থাপনার অবস্থান।
 *খুশাব (Khushab):* এখানে পাকিস্তানের প্লুটোনিয়াম উৎপাদনকারী চুল্লিগুলো অবস্থিত।
 *কাহুটা (Kahuta): খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ (KRL)* এখানে অবস্থিত, যা পাকিস্তানের প্রধান পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণাগার এবং উচ্চ-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম (HEU) উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তির কেন্দ্র।
পাকিস্তান তার পারমাণবিক সক্ষমতা উন্নত করতে এবং অস্ত্রাগার বাড়াতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
*'অপারেশন সিন্দুর'* ভারতের একটি সামরিক অভিযান, যা ২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানের ওপর চালানো হয়েছিল। এই অভিযানের ফলে পাকিস্তানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির প্রধান দিকগুলো হলো:
 *সামরিক অবকাঠামো:*
   *এয়ারবেস এবং সামরিক স্থাপনা:* অপারেশন সিন্দুরে পাকিস্তানের অন্তত আট থেকে এগারোটি এয়ারবেস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নূর খান, রফিকেরি, মুরিদ, সুক্কুর, শিয়ালকোট, পাশরুর, চুনিয়ান, সারগোদা, স্কারু, ভোলারি এবং জ্যাকোবাবাদ। এই হামলায় পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রায় ২০% অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।
   *বিমান ও ড্রোন:* কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তানের একাধিক বিমান ও ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে, তবে এর সঠিক সংখ্যা এখনও প্রকাশিত হয়নি।
   *বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা:* পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে ভারতীয় হামলার সময় তারা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
   *সন্ত্রাসী ঘাঁটি:* ভারতের দাবি অনুযায়ী, পাকিস্তানের ৯টি প্রধান সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির ও লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করা হয়েছে, যেখানে লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মুহাম্মদ এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এতে শতাধিক জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে ভারত জানিয়েছে।
 *অর্থনৈতিক ক্ষতি:*
   *শেয়ারবাজার:* অপারেশনের পর পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে ব্যাপক পতন দেখা গেছে। তিন দিনে পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের সামগ্রিক ৬,৩৯৩.৮৭ পয়েন্টের ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের বিনিয়োগকারীরা ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন (প্রায় ২.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
   *আকাশসীমা বন্ধ:* হামলার পর পাকিস্তান তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে তাদের আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়েছে।
 *মানসিক ও কৌশলগত ক্ষতি:*
  *বিশ্বাসযোগ্যতা:* অপারেশন সিন্দুর পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্যই একটি বড় ধাক্কা ছিল। এটি পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা এবং তাদের পারমাণবিক হুমকির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
   *আস্থার সংকট:* তুরস্কের ড্রোন এবং চীনের সরবরাহ করা বিমান প্রতিরক্ষা ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (EW) সিস্টেমের উপর পাকিস্তানের আস্থায় চিড় ধরেছে, কারণ সেগুলো এই হামলায় কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।
   *সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের মূল্য :* এই অভিযানের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিয়েছে যে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।
   *আন্তর্জাতিক চাপ:* পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে, কারণ ভারতের দাবি অনুযায়ী, এই অভিযান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল।
 অপারেশন সিন্দুর পাকিস্তানের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুতর ক্ষতি করেছে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থান উভয়কেই প্রভাবিত করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ