বিশ্বে কে কত সহজে সীমান্ত পেরোতে পারে, কোন দেশের নাগরিকরা অন্য দেশে পা রাখলে তাদের ভিসা লাগে না — এইসব সূচকই এখন এক দেশের কূটনৈতিক মর্যাদা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন।
সম্প্রতি প্রকাশিত Henley Passport Index 2025-এর প্রতিবেদন সেই চিত্রই আবারও সামনে এনেছে।
শীর্ষে সিঙ্গাপুর, দ্বিতীয় স্থানে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া
হেনলি ইনডেক্স অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর ২০২৫ সালের তালিকায় আবারও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এই দেশের নাগরিকরা বিশ্বের ২২৭টি গন্তব্যের মধ্যে ১৯৩টি দেশে ভিসা ছাড়া বা অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা পান।
এর ঠিক পরেই আছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, যাদের নাগরিকদের ১৯০টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কিছু দেশ — যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইতালি ও স্পেন — যৌথভাবে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে, প্রায় ১৮৯টি দেশে সহজ ভ্রমণ সুবিধাসহ।
ভারতের অবস্থান: ৮৫-তম স্থান, মাত্র ৫৯টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার
এই প্রতিবেদনে ভারতের অবস্থান ৮৫-তম স্থানে — যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও, বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের প্রভাবশালী অবস্থানের তুলনায় তা যথেষ্ট নিম্ন।
বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকরা মাত্র ৫৯টি দেশে ভিসা ছাড়াই বা অন-অ্যারাইভাল ভিসা-তে ভ্রমণ করতে পারেন।
তুলনায় নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা-র মতো প্রতিবেশী দেশগুলির ভিসা-নীতি আঞ্চলিকভাবে অনেকটাই সহজীকৃত, ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের অবস্থান একপ্রকার মাঝামাঝি।
কেন ভারত পিছিয়ে আছে?
কূটনৈতিক সমঝোতার সীমাবদ্ধতা:
ভারতের সাথে অনেক দেশের ভিসা-মুক্ত চুক্তি এখনও হয়নি। পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য বা ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশে ভারতীয়দের ভিসা নিতে হয়।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা-নীতি:
সন্ত্রাস-বিরোধী এবং সীমান্ত-নিয়ন্ত্রণ নীতির কারণে ভারত অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশিদের জন্যও কঠোর ভিসা-নিয়ম বজায় রাখে। এর প্রভাব পারস্পরিক সম্পর্কেও পড়ে।
অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্য:
ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়লেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে “মোবিলিটি শক্তি” বা বৈশ্বিক চলাচলের সুবিধা সেই অনুপাতে বাড়েনি।
বিশ্বের অন্যদের সাফল্যের গল্প
সিঙ্গাপুর: ছোট হলেও বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে তারা প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভিসা-সহযোগিতা গড়ে তুলেছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া: শক্তিশালী পাসপোর্টের পেছনে রয়েছে প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং স্থিতিশীল কূটনৈতিক ভাবমূর্তি।
ইউরোপীয় দেশগুলো: ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ মুক্ত ভ্রমণ চুক্তি তাদের পাসপোর্ট শক্তিশালী করেছে।
ভারতের জন্য কী শিক্ষা?
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স কেবল ভ্রমণের স্বাধীনতার তালিকা নয়; এটি এক দেশের আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও সংযুক্তির পরিমাপক।
ভারতের পাসপোর্ট শক্তিশালী করতে হলে কিছু পদক্ষেপ অপরিহার্য—
দ্বিপাক্ষিক ভিসা-সহযোগিতা বাড়ানো: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ভিসা-চুক্তি জরুরি।
বিদেশি নাগরিকদের জন্য নীতি শিথিল করা: অন্য দেশকে ভিসা-মুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল সুযোগ দিলে তার পাল্টা সুবিধা পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা: বাণিজ্য ও পর্যটন সহযোগিতা বাড়ালে আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়ে।
নাগরিক ভ্রমণ-পরিসংখ্যান উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের নাগরিকদের ভ্রমণ-সংক্রান্ত ডেটা ও নিরাপত্তা-রেকর্ড ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা দরকার।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ
বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে পৌঁছেছে যেখানে “মোবিলিটি” নতুন এক শক্তির প্রতীক।
একটি শক্তিশালী পাসপোর্ট মানে কেবল ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ নয় — সেটি শিক্ষা, ব্যবসা, বিনিয়োগ, চিকিৎসা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দরজাও খুলে দেয়।
ভারত আজ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগোচ্ছে, কিন্তু সেই সাফল্যের প্রতিফলন যদি আন্তর্জাতিক চলাচলের স্বাধীনতায় না দেখা যায়, তবে সেটি এক অপূর্ণ সাফল্যই থেকে যাবে।
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫-এর রিপোর্ট ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে —
বিশ্ব দরজা খুলছে, কিন্তু ভারত এখনও সেই দরজায় কড়া নাড়ছে।
দেশের দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতি ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ-স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও উন্নতি অপরিহার্য।
কারণ, একবিংশ শতাব্দীতে পাসপোর্ট কেবল একটি ভ্রমণ নথি নয় — এটি এক দেশের মর্যাদার প্রতীক, তার নাগরিকের স্বাধীনতার প্রতিফলন।
0 মন্তব্যসমূহ