ইঞ্জিনিয়ার সুমন পাল
“আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মঞ্চে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ।”
এই পুরোনো প্রবাদটাই আজকের বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। ভারতও গত সাত দশকে বহুবার এ প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করেছে।
আজ ভারত এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন চীন, আমেরিকা ও রাশিয়া—তিনটি শক্তিধর দেশই তাকে নিয়ে কূটনৈতিক চাল চালছে। সাম্প্রতিক সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) সম্মেলনে বিশ্বের চোখে ভারতের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু এর মাঝেও প্রশ্ন একটাই: কাকে সত্যিই বিশ্বাস করা যায়?
চীন: বন্ধুত্বের আড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
স্বাধীনতার পর ভারত-চীন সম্পর্কের মূলে ছিল “হিন্দি-চিনি ভাই ভাই”-এর স্লোগান। কিন্তু ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধ সেই বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষ প্রমাণ করেছে সীমান্ত সমস্যা আজও অমীমাংসিত।
পাকিস্তানকে কূটনৈতিক সমর্থন ও বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে ভারতের বিরুদ্ধে তৎপরতা চীনের কৌশলের অংশ।
অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এশিয়ার নেতৃত্ব নিতে চাইলেও, তার প্রতিটি পদক্ষেপে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে।
চীন বন্ধুত্বের ভাষা বললেও, দীর্ঘমেয়াদে সে ভারতের জন্য বিশ্বাসযোগ্য নয়—এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
আমেরিকা: সহযোগিতার সুযোগ, সতর্কতার প্রয়োজন
আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিগত কয়েক দশকে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছে।
শীতল যুদ্ধের সময় মার্কিন নীতি পাকিস্তানপন্থী ছিল।
মানবাধিকার ইস্যু, বাণিজ্য শুল্ক এবং রাজনৈতিক চাপ—আমেরিকার স্বার্থকেন্দ্রিক নীতির উদাহরণ।
যদিও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে, তবুও মার্কিন মিত্রতা পরিস্থিতিভিত্তিক, স্থায়ী নয়।
আমেরিকার সঙ্গে অংশীদারিত্ব জরুরি হলেও, অন্ধ বিশ্বাস নয়, কূটনৈতিক সতর্কতা দরকার।
রাশিয়া: আস্থার মজবুত সেতু
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক বহু দশক ধরে গভীর আস্থার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় ৭০% অস্ত্রশস্ত্র রাশিয়ার তৈরি।
জাতিসংঘে কাশ্মীর থেকে শুরু করে পারমাণবিক চুক্তি—সবক্ষেত্রেই রাশিয়া ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ইউক্রেন সংকটের মধ্যেও রাশিয়া ভারতের কৌশলগত অংশীদার রয়ে গেছে।
রাশিয়া শুধু কৌশলগত নয়, আবেগগতভাবেও ভারতের এক স্থায়ী মিত্র।
SCO সম্মেলন ২০২৫: ভূরাজনীতির নতুন সমীকরণ
চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত SCO সম্মেলনে ২০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে, এশিয়া এখন বিশ্বের রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু।
সম্মেলনের সাইডলাইনে শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও নরেন্দ্র মোদীর হাসিমুখে আলাপচারিতার ভিডিও অনলাইনে আলোচনার জন্ম দেয়।
যদিও তা কূটনৈতিক সৌজন্যবোধের প্রকাশ, তবু বিশ্ব শক্তিগুলোর বার্তা স্পষ্ট: তারা বৈশ্বিক ভারসাম্য নিজেদের হাতে রাখতে চায়।
'জাতীয় স্বার্থই চূড়ান্ত' - ইতিহাস বলে দেয়:
1. চীন ভারতের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী, ভবিষ্যতেও বদলানো কঠিন।
2. আমেরিকা ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় মিত্র, কিন্তু নিজস্ব স্বার্থে সম্পর্ক গড়ে।
3. রাশিয়া ভারতের আস্থার প্রতীক, বহু দশকের প্রকৃত বন্ধু।
আজ ভারত বহুমুখী কূটনীতি চালিয়ে তার শক্তি ও মর্যাদা ধরে রেখেছে। ছবি, হাসি ও সৌজন্যের আড়ালে জাতীয় স্বার্থই আসল চালক।
0 মন্তব্যসমূহ