Advertisement

Responsive Advertisement

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কিছু অ-প্রচলিত সব্জি

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কিছু অ-প্রচলিত সব্জি

মানুষের খাদ্যতালিকায় সব্জি একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে যা কিনা বিভিন্ন দরকারী ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর। এরা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, খাদ্যতত্ত্ব, এন্টি অক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য অনুখাদ্যের এক অসাধারণ উৎস। এই সমস্ত উপাদানের পাশাপাশি সব্জি বিভিন্ন ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখারও দাবী রাখে।
ভারতবর্ষের মতো দেশে- সমীক্ষায় দেখা যায় যে প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতা রোগে এবং ৪৯ শতাংশ জনগণ আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন, আর লক্ষ কোটি শিশুরা অপর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন-'এ'র শিকার হচ্ছে।                  আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষালব্ধ সমীক্ষায় এটা খুব পরিষ্কার যে এমন কিছু খাবার আছে যা প্রতিনিয়ত গ্রহণ করার ফলে স্বাস্থ্যের সাথে সাথে কিছু দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমন অস্টিওপোরেসিস, ক্যান্সার, বহুমূত্র এবং হৃদ্যন্ত্রঘটিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হতে পারে। সেদিক থেকে বিচার করে নতুন শ্রেণীর কিছু খাবার নতুনভাবে কিছু গুরুত্ব বহন করছে যা কিনা কার্যকরী খাবার বা 'functional foods' অথবা নিউট্রাসিউটিকেল খাবার হিসাবে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রচলিত পুষ্টিগুণসম্পন্ন সব্জির সাথে এইসমস্ত নতুন, অ-প্রচলিত সব্জি আমাদের স্বাস্থ্যবর্ধক হিসাবে কাজ করতে পারে, কেননা এই সমস্ত সব্জিতেই রয়ে গেছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট বা ফাইটোকেমিকেলস্ যা কিনা দেহের ক্ষতিকারক মুক্ত আয়নগুলিকে ধ্বংস করে স্বাস্থ্যরক্ষা করে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ যেমন- লোহা, দস্তা, আয়োডিন, ভিটামিন-এ এবং কিছু প্রয়োজনীয় চর্বির অভাবজনিত কারণে আজকাল শিশুদের সঠিক বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে।
বর্তমানে, কিছু সংখ্যক অপ্রচলিত সব্জি যেমন ব্রকোলি, লাল বাঁধাকপি, চাইনিজ বাঁধাকপি, লেটুস, বুশ স্কোয়াশ, পাকচই ইত্যাদি পুষ্টির অভাবজনিত কারণের যেমন বিকল্প হিসাবে কাজ করছে, তেমনি খাদ্য বৈচিত্র্যতার ঝুড়িতে নতুন সব্জি ফসল হিসাবেও মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে।
সুস্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের আর্থিক উন্নয়ন তথা অপুষ্টিজনিত সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য নাগিছড়া উদ্যান ও ফল গবেষণা ও কেন্দ্রে প্রচলিত বিভিন্ন সব্জী চাষের সঙ্গে সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে শুরু হয়েছে অ-প্রচলিত কিছু সব্জী চাষ, যা কিনা ইতিমধ্যে রাজ্যের কৃষক মহলে দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে। আমাদের আশা আগামী বছরগুলিতে কৃষকরাই এই সমস্ত সব্জী বাজারজাত করে অধিক মুনাফা অর্জন করবেন এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবেন। এই মুখবন্ধে কৃষক ভাইদের জন্য আলোচনা করব পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কিছু অপ্রচলিত সব্জী চাষের কথা।

১। বুশ-স্কোয়াশ: 
প্রকৃতপক্ষে ইহা সামার স্কোয়াশ বা গ্রীষ্মকালীন স্কোয়াশ (Cucurbita pepo) হিসাবে পরিচিত। ঝোপ আকৃতির এই গাছ কুমড়ো গাছের মতো লতানো হয় না। সাধারণত চারা লাগানোর ৬ সপ্তাহের মধ্যে বুশ স্কোয়াশ খুব কচি অবস্থায় খাবারের জন্য তৈরী হয়। বিভিন্ন আকার ও আয়তনের এই স্কোয়াশ সবুজ, গাঢ় সবুজ অথবা হলুদ রং এর হয়।

চাষবাস পদ্ধতি:
জল নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত জৈব পদার্থ সম্বলিত উর্বর মাটি এই চাষের জন্য উপযুক্ত। ২৪-২৭° সেঃ-এ এর চাষ ভালো হয়। ফেব্রুয়ারী-মার্চ, জুন-জুলাই অথবা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এর চাষ করা যেতে পারে। মাঠ ৪-৫ বার কর্ষণ করে নিয়ে ৪৫x৪৫x৪৫ সেমিঃ গর্ত করে নিতে হবে এবং মাদা থেকে মাদা এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ১মিঃ x ১মিঃ। শুকনো গোবর ২০-২৫ মেঃ টন/হেঃ হিসাবে গর্তের উপরের মাটির সঙ্গে ভালো করে মেশাতে হবে। বর্ষায় লাগানো গাছের জন্য মাদা উঁচু করে করতে হবে।

জাতঃ ১। অস্ট্রেলিয়ান গ্রীণ ২। পুসা অলংকার।

সার প্রয়োগঃ হেক্টর প্রতি ৭৫:৮০ঃ ৮০ কেজি নাইট্রোজেন: ফসফরাস: পটাশ ব্যবহার করতে পারেন। সম্পূর্ণ ফসফরাস ও পটাশিয়াম এবং অর্দ্ধেক নাইট্রোজেন মূল জমি তৈরী করার সময় প্রয়োগ করুন এবং বাকী অর্দ্ধেক নাইট্রোজেন তিন দফায় যথাক্রমে চারা লাগানোর ২০, ৪০ ও ৬০ দিন পর চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করুন। তবে সার প্রয়োগের আগে মাটি পরীক্ষা করে নিয়ে মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করাটাই বিজ্ঞানসম্মত হবে।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা: জমি আগাছা মুক্ত রাখুন। মাটির তস্ বুঝে ৩-৪ দিন পর পর সেচের ব্যবস্থা করুন।

ফসল তোলাঃ এক তৃতীয়াংশ পরিপক্কতার সঙ্গে সঙ্গে স্কোয়াশ তুলে নেওয়া যায়। এক-একটি স্ত্রী ফুলে ফল ধরা শুরু হওয়ার ৭-৮ দিনের মধ্যেই ফল পেরে নিতে হবে। কারণ কেবলমাত্র কচি অবস্থাতেই এই ফল খাওয়ার উপযুক্ত। কিছুদিন বেশী সময় গাছে থাকলে ফল খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। যত বেশী ফল তোলা হবে তত বেশী ফলন পাওয়া যাবে। বীজ লাগানোর ৬০-৮০ দিনের মধ্যে ফসল তোলার উপযুক্ত সময়। ফলন মোটামুটি ২০-৩০ মেঃ টন/হেঃ পাবেন। শষ্যের সময়কাল ৮৫-৯০ দিন। নাগিছড়া উদ্যান ও ফল গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষামূলক তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে সবুজ স্কোয়াশ ত্রিপুরা রাজ্যের শীতকালীন আবহাওয়ায় খুব ভালভাবেই চাষ করা যেতে পারে।

২। চাইনিজ বাঁধাকপি:

এটি কি? কিভাবে খাবেন?

বিজ্ঞানসম্মত নামঃ (Brassica rapa Var. Pekinensis) পরিবার: Brassicaceae পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সব্জি চাইনিজ বাঁধাকপি। যদিও তার উৎপত্তি চীন দেশে, তাও জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতবর্ষে এই সব্জি চাষে ব্যাপকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। হালকাভাবে রান্না করে, স্যুপ অথবা ভেজে খাওয়া যায়। একটু লম্বা আকৃতির, সাধারণ বাঁধাকপির মতো আঁটোসাটো হয়ে বাঁধবে না। পাতা স্যালাড হিসাবে ব্যবহার করা যাবে।

উন্নতজাতঃ দুই ধরণের জাতের মধ্যে কোনটার মাথা সাধারণ বাঁধাকপির মতো বাঁধবে, কোনটার বাঁধবে না।

মাথা (Head) বাঁধবে এমন জাতঃ মিচ্ছিলি, ওয়াংবক ইত্যাদি।

মাথা বাঁধবে না এমন জাতঃ অল সিজন নং-২, হাইব্রীড অপটিকো, ইত্যাদি।

চাষবাস পদ্ধতিঃ যদিও সাধারণ বাঁধাকপির মতোই এর চাষবাস পদ্ধতি তথাপি ১২-২২° সেঃ তাপমাত্রায় এই ফসল ভালো হবে। কানি প্রতি প্রায় ৯০ গ্রাম বীজ দরকার হবে। ৩-৪ সপ্তাহ বয়স্ক ৫-৮ পাতা বিশিষ্ট চারা মূল জমিতে লাগাতে হবে। তাড়াতাড়ি বেরে উঠার জন্য বীজ সরাসরি মূল জমিতেও লাগানো যায়। চারা থেকে চারা এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৩০x৪৫ সেমিঃ। অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা তৈরী করার উপযুক্ত সময়।

সার প্রয়োগ: যদিও চাইনিজ বাঁধাকপি সব ধরণের মাটিতেই হয়, তথাপি জল নিকাশের সুবিধাযুক্ত ভারী জৈব পদার্থ সম্বলিত মাটিই এর জন্য উপযুক্ত। ভাল ফলনের জন্য হেক্টর প্রতি ১০-১২ মেঃ টন শুকনো গোবর, ১২০ কেজি নাইট্রোজেন, ৬০ কেজি ফসফরাস ও ৫০ কেজি পটাশ সার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগে ভাল ফলপাওয়া যাবে। নাইট্রোজেন সার ১/৩ (এক তৃতীয়াংশ) মূল জমি তৈরীর সময় এবং বাকী ২/৩ চারা লাগানোর ৩০ দিন পরপর ২ বারে সমানভাবে প্রয়োগ করুন।

ফসল তোলা ও ফলনঃ চারা লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পর গোড়ার দিকে ফসল কেটে নিতে হবে। হেক্টর প্রতি ৪৫০-৫০০ কুইন্টাল পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
নাগিছড়া উদ্যান ফসল গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিটি চাইনিজ কপির ওজন প্রায় ১.২ কেজিঃ থেকে ২ কেজির মতো পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞানসম্মত নাম : Lactuca Sativa.
পরিবার: Asteraceae
এটির পাতা স্যালাড হিসাবে উপযুক্ত। শীতকালীন এই সব্জি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার পাশাপাশি ভারতবর্ষের হিমাচল প্রদেশে এই চাষের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা গেছে। স্যালাড শষ্য হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী এলাকায় লেটুসের চাষ হয়। খাদ্য সচেতন মানুষের জন্য এই সব্জির গুরুত্ব অনেক। বেশ কয়েক ধরণের লেটুস পাওয়া যায়। যেমন- Crisp Head, butter head, romaine & Loose Leaf দুই ধরণের লেটুস এর মধ্যে হেডিং টাইপ ও নন হেডিং। টাইপ দুটোই চাষ করা যেতে পারে।

জাত: ১) ক্রিসপ হেড: গ্রেট লেইক (আইসবার্গ নামেও পরিচিত), ইমপেরিয়েল-৪৪।

২) বাটার হেড: হোয়াইট বোষ্টন। ৩) রোমেইন: ডার্ক গ্রিন। ৪) ল্যুজ লি: লোলোরোসা (লাল), রিভলিউশন (লাল)

চাষপদ্ধতিঃ ১০-২০° সেন্টিগ্রেড অর্থাৎ শীতকালে এই চাষের জনপ্রিয়তা বেশী, রাত্রির ঠান্ডা আবহাওয়া লেটুস চাষের জন্য ভালো এবং পাহাড়ি এলাকায় এর চাষ ভালো হয়। সেপ্টেম্বর-নভেম্বর কম টিলা এলাকায় চারা তৈরী করার উপযুক্ত সময়। গ্রীষ্মের তাপ বাড়ার সাথে সাথে গাছে ফুল হয়ে যাবে এবং পাতার স্বাদ তেতো হয়ে যেতে পারে। ৬৫-৭০ গ্রাম বীজ কাণি প্রতি প্রয়োজন।

সার প্রয়োগ: মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী অথবা ১০-১২ মেঃ টন শুকনো গোবর, ৬৫ কেজি নাইট্রোজেন, ৪০ কেজি ফসফরাস ও ৪০ কেজিঃ পটাশ সার প্রতি হেক্টরে প্রয়োজন। ১/৩ নাইট্রোজেন মূলজমি চাষের সময় এবং বাকী ২/৩ নাইট্রোজেন চারা লাগানোর পর ৩০ দিন পর পর ২ বার চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করা উচিত। ৩-৪ সপ্তাহ বয়সের ৪-৫ পাতাবিশিষ্ট চারা লাইন থেকে লাইন এবং গাছ থেকে গাছের মধ্যে ৪৫ x ৩০ সেঃ দূরত্বে লাগাতে হবে। মাটির অবস্থার নিরিখে জলসেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ফসল তোলা ও ফলন: চারা লাগানোর পর ৫০-৬০ দিন বয়সের ফসল তোলার উপযুক্ত সময়। পাতায় জলের পরিমাণ খুব বেশী হওয়ার লেটুস বেশী দিন সংরক্ষণ করা কঠিন। হেক্টর প্রতি ৮-৯ মেঃ টন ফসল পাওয়া যাবে।

৪) লাল বাঁধাকপি:

বিজ্ঞানসম্মত নাম: (Brassica Olearacea. Sub Group rubra) পরিবার: Brassicaceae

স্যালাড সজ্জায় এবং সাধারণ বাঁধাকপির মতো রান্না করে খাওয়ার জন্য লাল বাঁধাকপির জুরি নেই। তাই আজকাল অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানের সূত্র হিসাবে এর চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা কুড়াচ্ছে। গত দু-বছর ধরে নাগিছড়া উদ্যান ও ফল গবেষণা কেন্দ্রে সাফল্যের সঙ্গে এর চাষ বাস হচ্ছে- যা এরই মধ্যে রাজ্যের কৃষকদের বাড়তি উৎসাহের সঞ্চার করেছে। বাঁধাকপির এই লাল রং-এর জন্য ২ প্রোপেনাইল আইসোথায়োসায়ানেট এবং ৩-বিউটানাইল আইসোথায়ো সায়ানেট উপাদানই দায়ী। ভিটামিন সি সমতুল্য গুণাগুণ সম্পন্ন এন্টি অক্সিডেন্ট সাধারণ বাঁধাকপির তুলনায় ৬-৮ গুণ লাল বাঁধাকপিতে পাওয়া যায়।
এই সব্জিটির লাল রঙের জন্য দায়ী এন্টি অক্সিডেন্ট (Polyphenol anthocyanin) মস্তিস্কের কোষের ক্ষতি রোধ করে, স্মৃতিভ্রম জনিত রোগের প্রতিরোধে উপকারী বলে এটি দাবী রাখে এবং চোখ ও ত্বকের জন্য এটি উত্তম।

জাতঃ রেড রক, রেড ড্রাম হেড, প্রাইমেরো ইত্যাদি।

চাষবাস পদ্ধতিঃ শীতকালীন ফসল এবং চাষের পদ্ধতি প্রায় সবটাই সবুজ বাঁধাকপির মত। অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা তৈরী করার উপযুক্ত সময়। ৭০-৮০ গ্রাম বীজ প্রতি কানির জন্য প্রয়োজন।
৩-৪ সপ্তাহ বয়সের ৪-৫ পাতা বিশিষ্ট চারা মূলজমিতে লাগাতে হবে। ভারী, জৈবপদার্থ সম্বলিত, জলনিকাশের সুবিধাযুক্ত মাটি এই চাষের উপযুক্ত।

সার প্রয়োগ: ২০ মেঃ টন শুকনো গোবর, ১০০ কেজিঃ নাইট্রোজেন, ১০০ কেজি, ফসফরাস এবং ১০০ কেজিঃ পটাশ হেক্টার প্রতি প্রয়োগ করতে হবে। মাটির অম্লত্বের উপর নির্ভর করে অনুখাদ্য হিসাবে বোরণ ও মলিবডেনাম প্রয়োগ করা ভালো। লাইন থেকে লাইন এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৪৫x৪৫ সেমিঃ। তবে দুটো লাইনের মাঝখানে কেইল তুলে দেওয়া ভালো।

সেচ: মাটির অবস্থা বুঝে সেচ প্রয়োগ করুন। খুব গরমের পর হঠাৎ সেচে কপির মাথা ফেটে যেতে
পারে। তাই নিয়মিত সেচের ব্যবস্থা রাখা ভালো।

ফসল তোলা ও ফলনঃ লাল বাঁধাকপির লাল রং ফিকে হওয়ার আগেই ফসল তুলতে হবে। সাধারণতঃ চারা লাগানোর ৬০-৬৫ দিনের মধ্যেই ফসল তোলা যাবে। ৬-৭ মেঃ টন হেক্টর প্রতি ফলন পেতে পারেন।

৫। ব্রকোলি:

বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Brassica oleracea. Var. Italica L

পরিবার: Brassicaceae
ফুলকপির মতোই অনেকটাই দেখতে কিন্তু পুষ্পমুকুলটি (Sprout) দেখতে গাঢ় সবুজ রং-এর। হাল্কাভাবে রান্না করে, স্যুপ হিসাবে, স্যালাড এবং মিশ্র সব্জী হিসাবে এর গুরুত্ব অনেক। অনেকের মতে আজকের ফুলকপির পিতৃপুরুষ হিসাবে ব্রকোলি পরিচিত। Sulphdraphane নামক যৌগ সমৃদ্ধ হওয়ায় ক্রমঃবর্দ্ধমান ক্যানসার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন গুণ রয়ে গেছে এই ব্রকোলিতে।

জাতঃ কে.টি-সেল-১, পালাম সমৃদ্ধি, পাঞ্জাব ব্রকোলি, ওয়ালথাম-২৯, লাকি, ফিয়েস্তা ইত্যাদি।

চাষবাস পদ্ধতিঃ শীতকালীন ফসল হিসাবেই ব্রকোলি প্রসিদ্ধ।
১৫-২০° সেঃ তাপমাত্রা এই চাষের জন্য উপযুক্ত। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ত্রিপুরায় এর চারা তৈরী করার উপযুক্ত সময়। স্বল্প দৈর্ঘ্যের মূল বিশিষ্ট এই সব্জীর জন্য প্রতিনিয়ত জল ও খাবারের যোগান রাখা আবশ্যক। ৭০-৮০ গ্রাম বীজ প্রতিকাণি জমির জন্য প্রয়োজন। ২৩° সেঃ তাপমাত্রা বীজ অঙ্কুরোদ্গমের জন্য উপযুক্ত। তাই বীজ লাগানোর সময়কে ঐভাবে নির্দ্ধারণ করা উচিত। ৪-৫ সপ্তাহ বয়সের ৪-৫ পাতাবিশিষ্ট চারা মূল জমিতে লাগানো উচিত।

সার প্রয়োগ: ব্রকোলি নাইট্রোজেন গঠিত সারে দারুণ সাড়া দেয়। তাই হেক্টর প্রতি ২০ মেঃ টন শুকনো গোবরের সাথে ১৫০ কেজি: নাইট্রোজেন, ৮০ কেজিঃ, ফসফরাস এবং ৬০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করা বিজ্ঞানসম্মত।
শষ্য বৃদ্ধি দশায় প্রতি ২০ দিন পরপর অনুখাদ্য হিসাবে বোরণ, মলিবডেনাম ইত্যাদি পাতার স্প্রে করলে অনুখাদ্যের অভাবজনিত বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার হয়। (যেমন বোরণ ২০% ২ গ্রাম/ লিঃ জলে গুলে এবং অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ১ গ্রাম/ লিঃ জলে গুলে স্প্রে করা উচিত)। ছোট মাথা, ফাঁপা কান্ড, পাতার উপরি অংশ পুড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন অনুখাদ্যের অভাবজনিত লক্ষণ।
লাইন থেকে লাইন এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬০x৪৫ সেমিঃ বিজ্ঞানসম্মত। প্রাথমিক বৃদ্ধি দশায় যাতে জলের অভাব না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাথা বাঁধার (Head formation) সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেচের ব্যবস্থা রাখুন।

ফসল তোলা ও ফলন: পুষ্পমুকুল গুলো খুলে যাওয়ার আগেই পুরো গাছটা না তুলে পুষ্পমুকুলের প্রধান মাথাটি এমন সময়ে কেটে নিতে হবে যখন তা নিরেট অবস্থায় থাকে। কিছুদিন পর এই গাছ থেকে ছোটছোট পার্শ্বমুকুল শাখা (Spears) বেরুবে। এই অতিরিক্ত ফলন খাওয়া যেতে পারে বা আটি বেঁধে বিক্রি করা যেতে পারে। জলদি জাতের ক্ষেত্রে চারা লাগানোর ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে এবং মাঝারি জাতের ক্ষেত্রে ৬০-৯০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যাবে। গড় ফসল মোটামুটি ১০-১৫ মেঃ টন হেক্টর প্রতি পেতে পারেন। নাগিছড়ায় পরীক্ষা মূলক চাষে দেখা গেছে শীতকালে পরপর দুটো ফসল তোলা যায়।

৬) পাকচই:

বিজ্ঞানসম্মত নাম: Brassica rapa. Var. Chinensis
পরিবার: Brassicaceae

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই সজীটি চীনে দারুণ জনপ্রিয়। এটি খুব সহজে চাষ করা যায় এমন একটি সব্জি এবং জৈব সার প্রয়োগে খুব ভাল সারা দেয়। এই সব্জি ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। খুব অল্পদিনের মধ্যেই ফসল তোলা যায় বলে এই সব্জিটি মূল ফসল হিসাবে চাষ করা ছাড়াও দুটি ফসলের মাঝখানে অন্তবর্তীকালীন ফসল হিসাবে চাষ করে বাড়তি উপার্জন করা সম্ভব।
যদিও ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই চাষের প্রচলন শুরু হয়েছে। নাগিছড়া উদ্যান ও ফল গবেষণা কেন্দ্রে বিগত দুই বৎসর ধরে এর চাষ সাফল্যের সঙ্গেই হচ্ছে।
সব্জীটির পাতা নরম, রসালো এবং শিরা উপশিরা সাদা অথবা সবুজ রঙের হয়। সঙ্গীটির একটা আলাদা মিষ্টি গন্ধ আছে যা তাকে জনপ্রিয় করেছে। পুরো গাছটাই শাক্, স্যালাড বা চচ্চোরি হিসাবে আপনি খেতে পারেন।

জাত: গ্রীণ বেবী, ক্যান্টন-জি-হোয়াইট ইত্যাদি।
আবহাওয়া: পাকচই সাধারণতঃ শীতকালীন ফসল হিসেবেই জনপ্রিয়। ১৫-২০° সেঃ তাপমাত্রায় এই চাষ ভাল হয়। পাকচই যদিও কুয়াশা সহ্য করতে পারে, তথাপি জোরালো বাতাস তার উৎপাদন এবং গুণগতমান ব্যাহত করবে।

চাষবাস: লম্বাকৃতি পাকচই-এর ক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইন এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫x৩০ সেমিঃ উপযুক্ত। বেঁটে জাতের পাকচই লাইন থেকে লাইন ১৮-২০ সেমিঃ এবং গাছ থেকে গাছ ১০ সেমিঃ দূরত্বে রাখা যেতে পারে। পাকচই সরাসরি বীজ বুনে বা চারা তৈরী করেও করা যেতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পাকচই গ্রীন হাউস অবস্থায় ভাল ফলন দেবে।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পাকচই লাগানোর উপযুক্ত সময়। ৭-৯ কেজি বীজ হেঃ প্রতি প্রয়োজন। ২৫ মেঃ টন শুকনো গোবর, ৭০ কেজি নাইট্রোজেন, ১১০ কেজি ফসফরাস ও ৭০ কেজি পটাশ প্রতি হেক্টর চাষের জন্য প্রয়োজন। অর্দ্ধেক নাইট্রোজেন এবং পুরো ফসফরাস ও পটাশ শেষ চাষে ব্যবহার করা উচিত, আর বাকী অর্দ্ধেক নাইট্রোজেন চারা লাগানোর ২০ দিন পর চাপান সার হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। তবে মাটি পরীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী সার ব্যবহার বিজ্ঞানসম্মত। ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকঘটিত রোগ প্রতিহত করার জন্য ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ২.৫ কেজিঃ ১০০ কেজিঃ শুকনো গোবর এবং সিউডোমোনাস ফ্লোরেসেন্স ২.৫ কেজি + ৪-৫ মিঃলিঃ নিমতেল প্রতি হেক্টরে ব্যবহার বিজ্ঞানসম্মত।

ফসল তোলা ও উৎপাদন: পাকচই চারা লাগানোর প্রায় ৩৫-৫৫ দিনের মধ্যে তোলা যায়। ৯০-১০০ শতাংশ আর্দ্রতায় ০-২° সেঃ তাপমাত্রায় পাকচই প্রায় ৭-১৪ দিন সংরক্ষণ করা যেতে পারে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ