বিশ্ব ইতিহাসে এমন কিছু স্থান রয়েছে, যেগুলি নিয়ে আজও রহস্য কাটেনি। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ইস্টার দ্বীপ (Easter Island) বা স্থানীয় নাম রাপা নুই (Rapa Nui) তারই অন্যতম। চিলি উপকূল থেকে প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপে রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো অদ্ভুত সব পাথরের মূর্তি—যেগুলোকে বলা হয় ‘মোয়াই’ (Moai Statues)। এই দ্বীপের অবস্থান, ইতিহাস, স্থানীয় জনজাতি এবং তাদের অমোঘ শিল্পকর্ম ঘিরে আজও গবেষণা চলছে, আবার রহস্যও জিইয়ে আছে সমানভাবে।
অবস্থান ও ভৌগোলিক পরিচিতি
ইস্টার দ্বীপ দক্ষিণ আমেরিকার চিলি রাষ্ট্রের অন্তর্গত একটি ছোট আগ্নেয়গিরিমূলক দ্বীপ। আয়তনে মাত্র ১৬৩.৬ বর্গকিলোমিটার হলেও এর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা একে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। দ্বীপের আকার মোটামুটি ত্রিভুজাকার এবং তিনটি নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি— মাউন্ট তেরেভাকা, মাউন্ট পোইকে ও মাউন্ট রানো কাও— একে ঘিরে রেখেছে।
মোয়াই মূর্তি: এক অনন্ত রহস্য
দ্বীপটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো বিশালাকার পাথরের মূর্তি বা মোয়াই। এগুলি ১৩শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ৯০০-এরও বেশি মোয়াই মূর্তি এখানে ছড়িয়ে আছে।
প্রতিটি মূর্তির উচ্চতা গড়ে ১০ থেকে ৩০ ফুট, ওজন কয়েক টন।
মূর্তিগুলির মুখ লম্বাটে, চোখ গভীর, ঠোঁট দৃঢ়—যেন কোনো রহস্যময় শক্তির প্রতীক।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, অধিকাংশ মূর্তি সমুদ্রের দিকে নয়, বরং দ্বীপের অভ্যন্তরের দিকে মুখ করে।
ধারণা করা হয়, মোয়াই ছিল পূর্বপুরুষদের প্রতীক, যারা জনজাতিকে রক্ষা করত।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—এত বিশাল পাথরের মূর্তি দ্বীপের মানুষ কীভাবে খোদাই করল, কীভাবে স্থানান্তর করল? এখনো কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই।
রাপা নুই জনজাতি ও তাদের সভ্যতা
দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের বলে রাপা নুই জনগোষ্ঠী। ধারণা করা হয়, তারা মূলত পলিনেশিয়ান নাবিকদের বংশধর, যারা সমুদ্রপথে এখানে এসে বসতি গড়েছিল প্রায় ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
রাপা নুইরা ছিল দক্ষ কৃষিজীবী ও ভাস্কর।
তারা বিশ্বাস করত পূর্বপুরুষদের আত্মা মূর্তির মধ্যে বিরাজ করে এবং গ্রামকে সুরক্ষা দেয়।
তবে অতিরিক্ত মূর্তি নির্মাণ ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে দ্বীপে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। সময়ের সঙ্গে তাদের সভ্যতা ধ্বংস হতে শুরু করে।
১৭২২ সালে ডাচ নৌ-অভিযাত্রী জ্যাকব রগেভেন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে দ্বীপে পা রাখেন। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয়দের আগমন, রোগব্যাধি, দাস শিকার এবং সংঘর্ষ রাপা নুই জনগোষ্ঠীকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
রহস্য ও গবেষণা
ইস্টার দ্বীপ নিয়ে গবেষকরা এখনো নানা তত্ত্ব খুঁজে চলেছেন।
মূর্তি স্থানান্তর রহস্য – এত ভারী মূর্তি কীভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো? কেউ বলেন গাছ কেটে স্লেজ বানানো হয়েছিল, কেউ বলেন মূর্তিগুলোকে “হাঁটিয়ে” আনা হতো দোল খাওয়ানোর কৌশলে।
সভ্যতার পতন – কেউ বলেন বনভূমি ধ্বংস করে নিজেরাই ধ্বংস ডেকে এনেছিল রাপা নুইরা। আবার কেউ মনে করেন, বহিরাগতদের আক্রমণ ও রোগব্যাধিই মূল কারণ।
অর্থবহ প্রতীকীতা – মোয়াই কি শুধু পূর্বপুরুষদের স্মৃতিস্তম্ভ, নাকি এর সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও সম্পর্ক ছিল? এ নিয়ে মতভেদ আজও আছে।
আজকের ইস্টার দ্বীপ
বর্তমানে ইস্টার দ্বীপ চিলির অধীনে হলেও এর নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ আছে। এখানে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করে। দ্বীপটি এখন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন রহস্যময় মোয়াই মূর্তি দেখতে ও রাপা নুই সংস্কৃতি জানতে।
উপসংহার
ইস্টার দ্বীপ কেবল একটি দূরবর্তী দ্বীপ নয়; এটি মানব সভ্যতার বিস্ময়, শিল্পকৌশলের নিদর্শন এবং একইসঙ্গে একটি অমীমাংসিত রহস্য। পাথরের নিস্তব্ধ মূর্তিগুলো আজও যেন প্রমাণ দেয়—মানুষের কল্পনা ও সৃজনশীলতা সময়কে অতিক্রম করতে পারে, তবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ