Advertisement

Responsive Advertisement

বিজ্ঞান ভিত্তিক লিচু চাষবাস পদ্ধতি

সেপিনডেসি পরিবারভুক্ত, উপপরিবার-নেফালেসি, লিচুর বৈজ্ঞানিক নাম Litchi chinensis (Gaertn) সাধারণতঃ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফসল। চীনেই লিচুর উৎপত্তি, পরে চীন থেকে মায়ানমার এবং সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে ভারতে এর আবির্ভাব হয়।

লিচু গাছ প্রায় ৬-৯ মিঃ লম্বা, ছড়ানো শাখা প্রশাখা এবং ঘন হালকা চক্চকে সবুজ পাতা দিয়ে গাছ আবৃত থাকে। পাতা যৌগিক, ফুলের মুকুল কোমল ও লোমযুক্ত হয়। ফল ডগায় ডগায় একগুচ্ছ করে হয়। ফলের শাঁস সাদা থলথলে হয়, একে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় বলে এরিল।

পরিচিতি ও প্রিয় ফলের মধ্যে লিচু এই রাজ্যে এক বিশেষ স্থানে রয়েছে। রূপে, গুণে ও স্বাদে লিচু একটি উপাদেয় ফল, এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, শর্করা জাতীয় পদার্থ ও ভিটামিন 'সি' থাকায় লিচু একটি পুষ্টিকর ফল। এশিয়া মহাদেশের চীনদেশে লিচুর সূচনা হলেও সপ্তদশ শতাব্দীতে লিচু ভারতে সূচনা হয়। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও দঃ ভারতের বেশ কিছু স্থানে লিচুর চাষ হয়।

মাটি ও আবহাওয়া: 
বেলে দোঁয়াশ বা দোঁয়াশ মাটিতে যেখানে মাটি অল্প অম্ল (৫.৫-৭ PH) সেখানে লিচুর ফলন ভালো হয়, ত্রিপুরা রাজ্যের আবহাওয়া লিচু চাষের জন্য যথেষ্টই উপযুক্ত, লিচু গাছের ফুল ফোটার সময় ২১°সেঃ থেকে ৩৮০সেঃ তাপমাত্রা উপযুক্ত। জমিতে জল জমলে গাছের গোড়ায় পচা রোগ হতে পারে। গ্রীষ্মকালে গরমবাতাস, প্রখর তাপ গাছের পক্ষে ক্ষতিকর। ক্ষার মাটি লিচু চাষের জন্য ভালো বলে জমিতে চুন ব্যবহার করা ভালো।

গাছের প্রয়োজনীয় কিছু ছত্রাক:
মাইকোরাইজা সমেত পুরনো গাছের গোড়ার মাটি নতুন বাগিচায় এনে ছড়িয়ে দিলে নতুন গাছের উপকারে আসে।

বংশবিস্তার: 
যদিও লিচু কাটিং অথবা কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়, তবে 'গুটি কলমের' মাধ্যমে লিচুর চারা তৈরীর পদ্ধতিই পৃথিবীতে বেশী জনপ্রিয়। সঠিক ও ভালো জাতের অধিক ফলনক্ষম গাছ থেকে গুটি কলম করতে পারলে উৎপাদনশীলতা অনেক বাড়তে পারে।

কিভাবে গুটি কলম করবেন?
ক) সুস্থ নীরোগ গাছ থেকে পেন্সিলের মতো মোটা এক বছরের ডাল থেকে জুনমাসের মাঝামাঝি সময়ে ২ সেমিঃ আংটির মতো ছাল মুকুলের ঠিক নীচ থেকে চেঁছে নিয়ে ১০০০ পিপি এম (২-১০ গ্রাম/ লিঃ জলে গুলে) ইনডোল বিউটারিক অ্যাসিড হরমোন পেস্ট কাটা অংশে লাগিয়ে মস্ ঘাস না পাওয়া গেলে পচাগোবর মাটি মিশিয়ে ঢেলা করে ব্যবহার করতে পারেন। মাটি পুরানো লিচু গাছের গোড়া থেকে এনে ব্যবহার করলে ভালো।

খ) পলিথিন বাঁধনের উপর-নীচ খুব শক্ত করে রাবার দিয়ে বা গুনা দিয়ে বেঁধে দিয়ে বাতাসমুক্ত করে রাখতে হবে।

গ) দুইমাসের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমানে মূল বেরুলে ডালটি গুটির ঠিক নীচে কেটে পলিথিন ব্যাগে লাগিয়ে রাখতে হবে।

ঘ) মাতৃগাছ থেকে গুটি কেটে নেওয়ায় ২-৩ সপ্তাহ পর থেকে স্প্রিঙ্কলার সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঙ) কমপক্ষে ৬-১২ মাস বছর পুরনো গুটির চারা বর্ষাকালে মূলজমিতে লাগানো ভালো।

চ) গুটি চারা মাতৃগাছ থেকে আলাদা করার পর ডালের অতিরিক্ত পাতা ছেঁটে ফেলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

জাতঃ যদিও বিহারেই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশী লিচু উৎপাদন হয়, তথাপি বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন জাতের লিচুর চাষ হয়। 

ত্রিপুরা রাজ্যের আবহাওয়ার জন্য কিছু উন্নত জাতের লিচুর বর্ণনা দেওয়া হলঃ

ক) সাহী :  এর ফল বড় হয় এবং গড় উৎপাদন প্রায় ৯০-১০০ কেজিঃ/গাছ। জলদি জাতের লিচু সাহী ত্রিপুরার আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত। : লিচুর এই জাতটি ফল ফাটা প্রতিরোধ করতে পারে। জলদি এই জাতটিই ভারতের প্রথম জাত।

খ) স্বর্ণরুপা: লিচুর এই জাতটির ফল ফাটা প্রতিরোধ করতে পারে। জলদি এই জাতটিই ভারতের প্রথম জাত। 

গ) চায়না : এই জাত জুন মাসের মাঝামাঝি পাকে। ফল বেশ মিস্টি ও স্বাদে অতুলনীয় হয়। ৮০-১০০ কেজিঃ / গাছ ফলন পাওয়া যেতে পারে। ফলের আকার মাঝারি সাইজের হয়।

ঘ) ইলাচি : জুনমাসের শেষদিকে পাঁকতে শুরু করে। ফলের আঁটি ছোট হয়। ফলের আকার মাঝারি সাইজের হয়, তবে বেশী মিষ্টি গড় ফলন ৫০-৬০ কেজি/গাছ।

ঙ) বোম্বাই : প্রতিবছরই ফলন হয়, গড় উৎপাদন প্রায় ৮০-৯০ কেজি/ গাছ।

চ) লেট বেদানা: কোন আকৃতির এই জাত বেশ দেরীতে ফল দেয়। গড় উৎপাদন প্রায় ৮০-১০০ কেজি/ গাছ।

ছ) দেরাদুন : জুন মাসে এর ফল পরিপক্ক হয়। হৃদয় আকৃতির এই জাতের গড় ফলন ৮০-৯০ কেজি/ গাছ।

জ) মজঃফরপুর : বড় ডিম্বাকৃতির এই জাতের গড় উৎপাদন প্রায় ৮০-১০০ কেজি/ গাছ।

ঝ) রোজ সেন্টেড: মধ্যম থেকে বড় আকৃতির এই জাতের ফলের গন্ধ গোলাপের মতো। এর গড় উৎপাদন প্রায় ৮০-৯০ কেজিঃ / গাছ।
ফল ধরার প্রবণতা, প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা, পরিপক্কতার সময় এবং গুণের দিক্ দিয়ে বিচার করলে মজঃফরপুর, স্বর্ণরুপা, বোম্বাই, লেট বেদানা, সাহী ইত্যাদি জাতগুলি ত্রিপুরা রাজ্যে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যেতে পারে।

লিচুর এলাকা ও উৎপাদন

দেশ - এলাকা (হেক্টর)/ উৎপাদন (মেঃ টন)

ভারত - ৩১,৪১০ হেঃ/ ৯১,৮৬০ মেঃ টন

চীন - ৩৯,৭০০ হেঃ/ ৬১,৮২০ মেঃ টন
লিচু চাষবাস-কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা:
ক) চারা রোপন: গর্ত জলের উৎসের বিপরীত দিকে কমপক্ষে ১ মিঃX১ মিঃX১ মিঃ মাপের গাছ লাগানোর ৪ সপ্তাহ আগে তৈরী করুন। লিচুর চারা গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারি ১০মিঃ দূরত্ব বজায় রেখে লাগাতে হবে। ২০-২৫ কেজিঃ গোবর, ২ কেজিঃ হাড়গুঁড়ো, ৪০০ গ্রাম পটাশ এক ঝুরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্ত পূরণ করুন। এই ক্ষেত্রে পুরানো লিচু বাগান থেকে মাইকোরাইজা ছত্রাক সম্বলিত মাটি নতুন গর্তে দিতে পারলে নতুন গাছের বৃদ্ধি ভাল হবে। ৬-৯ মাসের বয়সের চারা লাগানোর জন্য নির্বাচন করতে পারেন।

খ) লিচু চাষে রাসায়নিক সারের মাত্রা: (কেজিঃ / গাছ)
ফসল তোলার পর বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সার প্রয়োগ করতে হয়। অনুখাদ্য হিসাবে জিঙ্ক সালফেট, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড এবং বোরন ৫০, ৫০ এবং ২০ গ্রাম প্রতিষ্ঠিত লিচু বাগানে প্রয়োগ করলে ফলের উৎপাদন বাড়বে পাশাপাশি তা ফল ঝরে পড়া এবং ফল ফাটা সমস্যা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যায়। লিচু গাছে রস সংগ্রহকারী মূল যেহেতু ২০-৩০ সেমিঃ গভীরতায় থাকে, সেজন্য লিচু বাগানে গভীর কর্ষণ না দেওয়াই ভালো।

গ) জলসেচ, আচ্ছাদন এবং জল সংরক্ষণ:
গাছের গোড়া পরিষ্কার রেখে শীতকালে হাল্কা সেচের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এক্ষেত্রে, কলসী সেচের মাধ্যমে জলসেচ ব্যবস্থাপনা শুখা মরশুমে দারুন উপকারে আসে। শুকনো পাতা দিয়ে গাছের গোড়ায় আচ্ছাদন তৈরী করতে পারলে ভাল জল সংরক্ষণ করা যায়। ফল আসার সময় গোড়ায় আচ্ছাদন তৈরী করে ৩-৪টি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে ফল ফাটা সমস্যা থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।

ঘ) সম্পূরক গাছ এবং অন্তবর্তীকালীন শস্যঃ
লিচু চাষের প্রথম পর্যায়ে পেঁপে, আনারস, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের গাছ দুটো লিচু গাছের মাঝামাঝি দূরত্বে (সারি থেকে সারি এবং গাছ থেকে গাছ) লাগানো যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সব্জী হিসাবে বরবটি, বিন, ঢেঁড়শ, বেগুন ইত্যাদিও লাগানো যেতে পারে। তাছাড়াও অতিরিক্ত জৈবসার ও রাসায়নিক মিার ব্যবহার করে হলুদ ও আদায় চাষ থেকেও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা যাবে।

ঙ) বাতাস নিয়ন্ত্রক গাছ: জোরালো বাতাস থেকে লিচু গাছকে রক্ষা করতে লম্বা জাতের বিভিন্ন বাতাস নিয়ন্ত্রক গাছ হিসাবে ইউক্যালিপটাস, জাম ইত্যাদি গাছ লিচু গাছ থেকে ১০মিঃ অন্তর অন্তর (বাগান তৈরীর কমপক্ষে ১২ মাস আগে) লাগানো ভাল।

চ) আগাছা দমনঃ সাধারণতঃ নিড়ি দিয়েই গাছের গোড়া সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে। তবে ডাইরোন অথবা এট্রাজিন আগাছা নাশক ২ কেজিঃ / একর হিসাবে এক মাস অন্তর অন্তর প্রয়োগে আগাছা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আগাছা দমনে কালো পলিথিন গাছের গোড়ায় ব্যবহারে জৈব আচ্ছাদন থেকেও ভাল ফল পাওয়া যাবে।

ছ) লিচুর পোকা মাকড় ও রোগঃ মাইট, পাতা মোড়ানো পোকা, কেটারপিলার এবং লিচু ফলছিদ্রকারী পোকা ত্রিপুরার আবহাওয়ায় খুব বেশী চোখে পড়ে। রোগের মধ্যে পাতার দাগ এবং ফল পঁচা রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশী।

জ) রোগ পোকা দমনের নিয়মাবলী:
রোগ ও পোকার নাম : 

১) ফল ছিদ্রকারী পোকা: কুইনলফস নামক ঔষধ ২ মিলিঃ/লি জলে গুলে ১৫ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করুন।

২) মাইট: নতুন পাতা আসতে আরম্ভ করলেই ১ মিলিঃ লিঃ/ লিঃ জলে গুলে প্রোফেনোফস্ ২-৩টি স্প্রে প্রতি ৭ দিন অন্তর অন্তর করতে পারলে তার প্রতিকার পাওয়া যায়। অবশ্যই ফুল আসার আগে এই স্প্রে করবেন।

৩) কেটার পিলার: প্রথমে কীড়া গর্তে ধোঁয়া জাতীয় ঔষধ- যেমন কার্বন ডাই সালফাইড, পেট্রোলিয়াম অথবা ফরমালিন দিয়ে পরে মাটি দিয়ে গর্ত পুরে দিলে তার প্রতিকার পাওয়া যায়।

৪) লিচুর পাতা মোড়ানো পোকা : ফসফামিডন জাতীয় ঔষধ ১.২৫ মিলিঃ লিঃ /লিঃ জলে গুলে ১০ দিন অন্তর অন্তর কমপক্ষে দুটো স্প্রে করুন।

৫) পাতার দাগ রোগ: লাইম সালফার ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৩টি স্প্রে বসন্তকালে এবং ৩টি স্প্রে বর্ষাকালে করতে পারলে তার উপকার পাওয়া যায়।

৬) ফল পচা রোগ: নিরোগ, ভালো ফলে ০.২৫ শতাংশ সোডিয়াম অর্থো ফিনাইল ফিনেট সম্বলিত মোমের প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে।



 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ