Advertisement

Responsive Advertisement

বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বেবিকর্ন বা কচি ভুট্টা চাষ


বেবিকর্ন বা কচি-ভুট্টা এক ধরনের উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা। ভুট্টা গাছের ফল বা মোচা বের হবার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে যখন অপরিণত অবস্থায় পেড়ে নেওয়া হয়, তখনি একে কচি-ভূট্টা বা বেবিকর্ন বলা হয়। বেবি কর্নের পুরুষ ফুলগুলিকে ফোটার আগেই ভেঙ্গে ফেলা হয় যেন স্ত্রী ফুলগুলির পরাগ সংযোজন না ঘটে। এই অনিষিক্ত কচি ফল গুলিকেই বেবিকর্ন বা কচি-ভুট্টা বলে। এটি একাধারে খেতে পুষ্টিকর এবং কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল। রেস্টুরেন্ট, হোটেলের সাথে সাথে বাড়িঘরেও বিভিন্ন খাবারে স্যালাড, স্যুপ, স্টার ফ্র্যাই, ডিপ ফ্র্যাই হিসাবে, প্রায় প্রতিটি চাইনিজ খাবারে এর ব্যবহার আজকাল হয়ে থাকে। ক্যান-এ ভরে, ফ্রোজেন অবস্থায়, আচার তৈরিতে বিশেষ শিল্পজাত কৃষি পণ্য হিসাবে এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।

পুষ্টিগত মান:
প্রতি ১০০ গ্রাম বেবিকর্নে প্রোটিনের মাত্রা থাকে ১০.০৮ গ্রাম, ফ্যাটের পরিমান ৮.৪৩ গ্রাম, ফাইবার-২.৪০ গ্রাম, সুগার-০.১৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-১৭. গ্রাম এবং ফসফরাসের পরিমান ১৯৭.৮৩ গ্রাম। এই আঁশযুক্ত, কোলেস্টেরল বিহীন অল্প ক্যালেরির ফসল সব্জী হিসেবে বিভিন্ন রকমের পোকোড়া থেকে পায়েশ এবং নানা রকমের মশলাদার খাবার হিসেবেও জনপ্রিয়।

ত্রিপুরার চাষের যৌক্তিকতাঃ
এই ফসল তুলতে সময় খুব কম লাগে, মাত্র ৫০ থেকে ৬০ (শীতকালে) দিন। তাই এক বছরে ধান চাষের সাথে সাথে অনায়াসে ২-৩ বার এই ফসল ঘরে তোলা যায় সঠিক ব্যবস্তাপনার মাধ্যমে। বাণিজ্যিকভাবে দেশের তথা আন্তর্জাতিক বাজারে এর তুমুল চাহিদা আর অল্প দিনে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব বলে ত্রিপুরার কৃষকদের কাছে এই বেবিকর্ন একটা নতুন এবং আকর্ষণীয় ফসল। ত্রিপুরার মাটিতে প্রাক-খারিফ মরসুমে এবং রবি মরসুমে বেশিরভাগ খালি জমিতে এর চাষ সম্ভব। তাছাড়া রাজ্যে অনেকগুলি আনারস ক্যানিং এর প্রক্রিয়াকরন কারখানায় সহজে বেবিকর্নের ক্যানিং করে বাজারজাত করা সম্ভব।

ত্রিপুরার জন্য উপযুক্ত জাতের বীজ:
বাজারে বিভিন্ন জাতের বীজ থাকলেও স্বল্পমেয়াদি, উচ্চ ফলনশীল, বেঁটে জাতের বীজ নির্বাচন করা উচিত। রাজ্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, অরুন্ধতিনগরে বেবিকর্নের PAC-321 এবং CPB-472 এই দুই জাতের বীজে খুব ভালো ফলন পাওয়া গেছে।

বীজ বপনের সময়:
সারা বছরই এই ফসল চাষ করা গেলেও প্রধান ফসল হিসাবে খারিফ খন্দে জুন থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে, রবি খন্দে অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম পক্ষকালের মাঝে এবং প্রাক-খারিফ খন্দের জন্য মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের মাঝে ফসল লাগানো প্রয়োজন।

জমি নির্বাচন ও বীজ লাগানোঃ
কাদা-দোঁআশ থেকে বেলে-দোআঁশ যেকোন মাটিতেই বেবিকর্ন চাষ করা যায়। শুধু অতিরিক্ত বৃষ্টির জল বের করার মতো সুবিধা থাকা প্রয়োজন। তাই ত্রিপুরায় খারিফ মরসুমে উঁচু মাঝারি জমির বেলে-দোআঁশ মাটি এবং নদীর তীরবর্তী এলাকার মাটিতে এই ফসলের চাষ সম্ভব। মাটির প্রকৃতির উপর বীজের পরিমান নির্ভর করবে। তবে মাটি রসালো ও ঝুরঝুরে হলে কানি প্রতি ৩-৩.৫ কেজি বীজই যথেষ্ট। খেয়াল রাখতে হবে হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা ১,০০,০০০ থেকে (২০ সেমি ১৫০ সেমি দূরত্বে) ১,৪৮,০০০ (১৫০৪৫ সেমি দূরত্বে) পর্যন্ত থাকা প্রয়োজন। যতো বেশি গাছ থাকবে ততো বেশি ফলন পাওয়া যাবে (বেবিকর্নের সবুজ গাছের অংশ গো-খাদ্য হিসাবে বাজারজাত হয়)। মাটি ঝুরঝুরে ৫ সেমি গভীরে বীজ বসানো হয়। তবে লাগানোর আগে প্রতি কেজি বীজে ২-৩ গ্রাম ক্যাপ্টান / থাইরাম / ব্যাভিস্টিন জাতীয় ঔষধ দিয়ে শোধন করতে হবে। মাটি বাহিত রোগ থেকে রক্ষা ট্রাইকোডারমা ভিরিডি/ ট্রাইকোডারমা হারজেনিয়াম / সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স/ বেসিলাস সাবটিলিস ইত্যাদি ব্যবহার করলে উৎপাদন এবং গুণমান বাড়ে। জমিতে উঁই পোকার সমস্যার জন্য ক্লোরোপাইরিফস জাতীয় ঔষধ প্রতি লিটার জলে ২ মিলি পরিমান মিশিয়ে বীজ বপনের আগে প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
প্রতি কানি জমিতে ১.৫ থেকে ২ টন করে পচা গোবর সার, প্রথম চাষ দেওয়ার ১৫ দিন আগে ভালো করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রধান সার হিসেবে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশ সার হেক্টর প্রতি ১৫০:৬০:৪০ কেজি অনুপাতে দেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য কানি প্রতি প্রাথমিক সার লাগবে ৪০-৪৫ কেজি ইউরিয়া, ৫৫-৬০ কেজি সিংগল সুপার ফসফেট (এস এস পি) এবং ১০-১২ কেজি মিউরেট অফ পটাশ (এম ও পি)। ইউরিয়া সারের অর্ধেক অংশ বীজ বপনের আগে শেষ চাষ দেওয়ার সময়, বাকি অর্ধেক আরো দুইবার হাঁটু সমান উচ্চতার বয়সে এবং ফুল আসার আগে প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হবে। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের বায়ো- ফারটিলাইজার (অ্যাজোটোব্যাক্টর / অ্যাজোস্পাইরিলাম / পি এস বি ইত্যাদি) ব্যবহার করলে উৎপাদন দারুনভাবে বাড়তে দেখা যায়।

জলসেচঃ
মাটির প্রকারভেদে জলসেচ পরিমান নির্ভর করে। সাধারণত বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পরে একবার, ৩০ দিন বা হাঁটু সমান বয়সে দ্বিতীয়বার এবং ফুল আসার আগে ৪০-৪৫ দিনের দিকে তৃতীয়বার জলসেচ গুরুত্বপূর্ণ। জমি নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জমিতে বৃষ্টির অতিরিক্ত জল না জমে।

আগাছা দমনঃ
যেহেতু বেবিকর্ণ ফসলের মেয়াদ মাত্র ৫০-৬০ দিন, তাই বাণিজ্যিক ভাবে ফসল চাষের ক্ষেত্রে একবার মাত্র (হাঁটু সমান বয়সে) বা খুব বেশি হলে দুইবার (বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মাথায় প্রথমবার) আগাছা দমন করা দরকার।

পুরুষ ফুলের মোচনঃ
বেবিকর্ন ফসল চাষের একমাত্র প্রধান কাজই হল পুরুষ ফুল ভাঙ্গা। সব ফসলের বেলায় যেমন পরাগায়ন দরকার হয়, বেবিকর্নের ক্ষেত্রে সেটা হয় না, বরং পরাগায়ন হলে বেবিকর্ন পরিপূর্ণ ভুট্টা ফসলে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তাই গাছে ৪০-৪৫ দিনের মাথায় পুরুষ ফুল আসার সাথে সাথে (শিষ পাতার মাঝ বরাবর পুরুষ ফুলের মোচা দেখা গেলে) সেগুলি ভেঙ্গে ফেলতে হবে যেন এরা পরিপূর্ণ ভাবে ফুটে পরাগায়ন না ঘটাতে পারে। 

সুসংহত পদ্ধতিতে রোগ পোকার ব্যবস্থাপনাঃ
বেবিকর্ন চাষে তেমন ভাবে কোন রোগ-বালাই দেখা যায় না। তবে কখনো কখনো পাতা ঝলসানো রোগ দেখা দিলে (প্রায় ৩৫-৪০ দিনের মাথায়), প্রোপিকনাজল বা মেনকোজেব জাতীয় ঔষধ ২.২৫ গ্রাম/ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত ক্ষেতেঝরা পাতা, গাছ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে যেন রোগ না ছাড়ায়। পোকার ক্ষেত্রেও সাধারণত অল্প দিনের ফসলে তেমন আক্রান্ত হয় না অথবা আক্রমনের তীব্রতা কম থাকে (below ETL) কিন্তু বিগত কিছু বছর থেকে এক নতুন ধরনের শোয়াপোকার আক্রমন সব ধরনের ভুট্টা ফসলেই দেখা যাচ্ছে, ফলআর্মিওয়ার্ম বা FAW। তবে ফেরমোন ট্র্যাপ ব্যবহার করে খুব অল্প খরচে এবং সহজে এর থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে কানি প্রতি ৬টা ফেরমোন ট্রাপ ব্যবহার করলে অনায়াসে পুরুষ মথকে আকৃষ্ট করে ফসলকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এছাড়াও শুকনো বালি এবং চুনের মিশ্রন ৯:১ আনুপাতে মিশিয়ে গাছের শিষ পাতায় প্রথম ৩০ দিন প্রয়োগ করলেও এই পোকা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়াও আক্রমন যদি খুব বেশি হয়, শেষ উপায় হিসেবে রাসায়নিক ঔষধ যেমন ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল ১৮.৫ এস সি, থায়ামিথোক্সাম ১২.৬%, স্পাইল্যাটোরাম ১১.৭% এস সি ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ফসল তোলা:
বেবিকর্নের বীজ লাগানোর ৪৫-৫০ দিনের মাথায় (খরিফ খন্দে) অথবা ৫০-৬০ দিনের মাথায় (রবি খন্দে) ধাপে ধাপে ফসল সংগ্রহ করা হয়। ফসল তোলার সঠিক সময় এই ফসলের বাজার দামের এক মাত্র নির্ণায়ক। সাধারণত ৮ থেকে ১০ সেমি লম্বা খোসা ছাড়ানো বেবিকর্ন "এ" (A) গ্রেড হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়। যদি ফসলের আকার ১০ থেকে ১২ সেমি হয়ে যায়, তাহলে দাম কমে "বি" (B) গ্রেড হিসেবে বিক্রি হয়। সাধারণত পুরুষ ফুল ভাঙ্গার সপ্তাহখানেক পরেই প্রথম ফসল তোলার জন্য তৈরি হয়ে যায়, দ্বিতীয় ফসল তাব আর ২-৩ দিন পরে, তৃতীয় ফসল আর ৩-৪ দিন পরে। এইভাবে মাটির উর্বরতা, তসের পরিমান এবং ফসলের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর ভিত্তি করে একে একে ৩-৪ বার ফলন প্রতি গাছ থেকে তোলা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে প্রতি একদিন অন্তর ও ফসল তোলতে হয়। বেবিকর্নের মোচার সিল্ক যখন ২ ইঞ্চি পরিমান লম্বা হয়, তখন ভিতরের কর্ন মোটামুটি ৮-১০ সেমি সাইজের হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা ১ লাখ থেকে ১.৫ লাখ বা কানি প্রতি ১৬ থেকে ২৪ হাজার হলে প্রতি গাছে যদি গড়ে ৩-৪ টি ফলন তোলা যায়, কানিতে ৪৮০০০ থেকে ৬৪০০০ অথবা ৭২০০০ থেকে ৯৬০০০ বেবিকর্ন ফসল তোলা সম্ভব।
ফলনঃ
বেবিকর্নের ফলন দুই মাত্রায় হয়ে থাকে, কর্নের ফলন এবং গাছের সবুজ অংশ পশু খাদ্য হিসেবে। যদিও ফসলের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর ফলন নির্ভর করে, তবুও মোটামোটি ভাবে ১২ থেকে ১৫ টন বেবিকর্ন (খোসা ছাড়িয়ে ১.৮ টন থেকে ১.৯ টন) এবং ১৫ থেকে ২০ টন সবুজ পশু খাদ্য এক হেক্টর জমি থেকে সহজে পাওয়া যায়। কানি হিসাবে প্রতি কানি জমিতে ২.৬ থেকে ৩.৫ কুইন্টাল বেবিকর্ন (খোসা ছাড়ানো) এবং ২০ থেকে ৩২ কুইন্টাল পশু খাদ্য পাওয়া যায়।

ফসর পরবর্তী পরিচর্যা:
বেবিকর্নের মোচা / খোসা ছাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, যদি এতে কর্নের মাথা ভেঙ্গে যায়, তাহলে বাজারজাত করতে এর দাম অনেকটা কমে যায়। প্রোসেসিং এর ক্ষেত্রে ফসল তোলার সাথে সাথে (১২-২৪ ঘন্টা) ফসলকে প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে (Processing / Canning Centre) নিয়ে যেতে হবে। ফসল তোলার পরে বেশি সময় রাখলে কর্নের গুণগতমান সময়ের সাথে সাথে খারাপ হতে থাকে।

লাভের পরিমান:
অল্পদিনের ফসলে অন্তবর্তী পরিচর্যা কম থাকায় গড়ে প্রতি কানি ফসল উৎপাদনে ৫-৫.৫ হাজার টাকা বা হেক্টর প্রতি ৩০-৩২ হাজার টাকা পড়ে। কিন্তু বেবিকর্ন এবং পশুখাদ্য বিক্রি করে অনায়াসে কানি প্রতি ২০-২২ হাজার টাকা বা হেক্টর প্রতি ১.৬-১.৯ লক্ষ টাকা পাওয়া সম্ভব। লাভের অংশ
হিসাব করলে বেবিকর্নে ১০-১২ হাজার টাকা কানি প্রতি এবং পশু খাদ্যে ৮-১০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ