Advertisement

Responsive Advertisement

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজু বাদাম চাষ

কাজু বাদাম একটি অর্থকরী বাগিচা ফসল। এই রাজ্যের লাল কাঁকুড়ে মাটির উঁচু-নীচু টিলা জমিতে প্রায় বিনা যত্ন ও পরিচর্যায় মোটামুটি ফলন দেয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হলে অনেক বেশী ফলন পাওয়া যায়। কাজুবাদাম গাছ খরা সহনশীল এবং অনুর্বর মাটিতে খুব ভালভাবে জন্মাতে পারে। তাই, অনুর্বর মাটি থেকে সোনা ফলাতে পারে এই কাজুবাদাম গাছ।

খাদ্য গুণাগুণ:
কাজুবাদাম একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এতে শতকরা ২১ ভাগ প্রোটিন, ৪৭ ভাগ চর্বি, ২২ ভাগ শর্করা এবং খনিজ লবন ও ভিটামিন আছে। তাছাড়া, কাজুবাদামের আপেলের রসে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন C আছে এবং এই ভিটামিন C এর পরিমাণ কমলালেবুর চেয়ে পাঁচগুণ বেশী।

উন্নতজাত:
ভেঙ্গুরলা-১, ভেঙ্গুরলা-৪, ভেঙ্গুরলা-৭, উলাল-৩, বি.এল. এ.-৩৯-৪।

বংশ বিস্তার:
নরম কান্ডের কলমের সাহায্যে বাগান করুন। বীজ থেকে উৎপন্ন চারা দিয়ে বাগান না করে কলমের চারা দিয়ে বাগান করার উদ্দেশ্য হল- কলম থেকে তৈরী চারার মাতৃ গাছের সমস্ত গুণাগুণ বজায় থাকে। অল্প বয়সে গাছ ফলন দিতে শুরু করে এবং বাগানের সব গাছে প্রায় একই রকম ফলন পাওয়া যায়।

বংশবিস্তার পদ্ধতিঃ
পেনসিলের মত পুরু বাদামী রঙের সায়ন নির্বাচন (বয়স ৩-৫ মাস) করে বৃন্তের উপরি ভাগের পাতাগুলি কেটে ৭-১০ দিন গাছে রেখে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে বৃন্তগুলি যেন আপনা আপনি ঝরে পড়ে। এবার, পেনসিলের মত পুরু ৪৫-৬০ দিন বয়সের চারা ২৫x১৫ সেমিঃ পলিব্যাগে রুট স্টকের জন্য নির্বাচন করুন। নীচের দুই জোড়া পাতা রেখে মাটি থেকে ১৫ সেমিঃ উচ্চতায় কেটে বাদ দিতে হবে। তারপর কান্ডটির মাঝ বরাবর ৬-৭ সেমিঃ গভীর করে কেটে দুইভাগ করে নির্বাচিত ১০ সেমিঃ লম্বা সায়ন শাখাটির ৬-৭ সেমিঃ আড়াআড়িভাবে কেটে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে রুট-স্টক ও সায়নের অন্তত্বক পরস্পর লেগে থাকে। জল থেকে রক্ষা পেতে এই জোড়াকে ২.০ সেমিঃ পাশ ও ৩০ সেমিঃ লম্বা, ১০০ গজের পুরু পলিথিনের ফিতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তারপর, সায়নটিকে ২০x৪ সেমিঃ পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ দিয়ে ঢেকে নীচের দিকটা রবার বেন্ড লাগিয়ে দিতে হবে যাতে ভিতরে জলীয় বাষ্প বজায় থাকে এবং চারাটিকে দুই-তিন সপ্তাহ ছায়ায় রেখে দিতে হবে, তিন সপ্তাহ পরে যখন কুঁড়ি দেওয়া শুরু হবে, পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ সরিয়ে কলমের চারাটিকে রৌদ্রে নিয়ে যেতে হবে এবং মূল জমিতে লাগানো পর্যন্ত যত্ন ও পরিচর্যা করা দরকার।

জমি তৈরী:
নির্বাচিত জায়গা থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করুন। গাছ লাগানোর ২মিঃ ব্যাসার্দ্ধের জায়গা থেকে আগাছার মূলগুলি সম্পূর্ণভাবে উপরে নির্মূল করতে হবে যাতে নতুন লাগানো কলমটি আগাছার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

গর্ত করা:
গর্তের মাপ ৬০ সেমিঃ × ৬০ সেমিঃ x ৬০ সেমিঃ এবং দূরত্ব সারি থেকে সারি ৭.৫ মি × ৭.৫ মি অথবা x৮ মি x ৮ মি সমতল জমির জন্য।
ঢালু জায়গায়, ১মিঃ x ১মিঃ x ১মিঃ গর্তের মাপে ৭.৫ মিঃ x ৭.৫ মিঃ অথবা ৮মিঃ x ৮ মিঃ দূরত্বে গর্ত করুন। আর যদি সমতল জমিতে বাগানের শুরুতে সাথী ফসল লাগাতে চান, তাহলে দূরত্ব দেওয়া যেতে পারে ১০ মিঃx৫ মিঃ। কলম লাগানোর ১৫-২০ দিন আগে গর্ত করে রোদ লাগাতে হবে যাতে উই পোকা দমন হয়। তারপর উপরের মাটির সঙ্গে ৫ কেজি আর্বজনা সার / পচা গোবর সার অথবা ২ কেজি মুরগীর মলসার এবং ২০০ গ্রাম রক ফসফেট মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করুন। কলমের গোড়াতে যাতে জল না জমে তার নিষ্কাশনের জন্য
নালা রাখতে হবে।

কলম লাগানোঃ
পাঁচ মাস বয়সের চারা লাগানোর সময়, পলিথিনের ব্যাগটি খুব সাবধানে খুলে গর্তের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দিন এবং লক্ষ্য রাখতে হবে কলমের জোড়টি যেন মাটি থেকে ৫ সেমিঃ উপরে থাকে।

খুঁটি দেওয়া এবং মালচিং:
চারা লাগানোর পরই গাছটিকে শক্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। মাটির আদ্রতা বজায় রাখতে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য' গাছের গোড়ায় মালচিং করে দিতে হবে।

যত্ন ও পরিচর্যা:
১) রুট-স্টক থেকে নিয়মিত মুকুল গজালে কেটে ফেলুন।

২) ধারালো সিকেটার এর সাহায্যে ০.৭৫ মিঃ-১.০মিঃ পর্যন্ত মূল কান্ডটি থেকে পার্শ্বমুকুল কেটে ফেলতে হবে যাতে পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী পরিচর্য্যাতে কোন অসুবিধা না হয়।
৩) ২য় এবং ৩য় বছরে পুরানো খুঁটি সরিয়ে নতুন খুঁটি লাগান।
৪) দুই বছর পর্যন্ত ফুল আসামাত্রই ফুল কেটে ফেলতে হবে এবং তৃতীয় বছর থেকে ১ম ফলন শুরু করবেন।
৫) দুর্বল বা আঁকাবাঁকা শাখাগুলি কেটে শুধু ৪-৫টা সবল ডালা রাখবেন।
৬) চার বছর পরে, ৩.৫ মিঃ-৪মিঃ উচ্চতায় গাছের শীর্ষ মুকুল এবং শীর্ষ ডাল কেটে দিতে হবে।


সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
উপরোক্ত সারের পরিমান বছরে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ১/৩ মে-জুন মাসে (বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আগে) এবং বাকী ২/৩ অংশ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। গাছের কেনোপির চারিদিকে বৃত্তাকারে মূল কান্ড থেকে ০.৭৫ মিঃ; ১.০ মিঃ এবং ১.৫ মিঃ দূরত্বে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং পরবর্তী বছরগুলিতে নালা কেটে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে মাটিতে যেন তস্ থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় রাসায়নিক সার দিলে সারের অপচয় হয়।

জল এবং মাটি সংরক্ষণ:
অর্ধচন্দ্রাকৃতি ১.৮-২.০ মিঃ ব্যাসার্দ্ধের সিরিবাঁধ করতে হবে ২য় এবং ৩য় বছরে, যদি আগে না করে থাকলে। সঙ্গে গড়ানো জল এবং মাটি জমা হওয়ার জন্য গর্ত ১.৫ (লম্বা) x০.৩ মিঃ (প্রস্থ) x ০.৪৫ মিঃ (গভীর) করতে হবে ঢালুর উপরের দিকে। গাছের গোড়ার চারদিকে জঙ্গল কাটা আগাছা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে করে ভূমিক্ষয় রোধ হয়। এর ফলে মাটিতে তস্ থাকবে এবং গাছ বাড়তি জৈব সার পাবে।

ফসল তোলা:
গাছের নীচ থেকে শুধু ঝরে পড়া ফলই সংগ্রহ করবেন। তারপর বাদামটি আপেল থেকে সরিয়ে ২-৩ দিন রৌদ্রে শুকিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে মাটি থেকে ৪" উপরে গুদামজাত করুন।

ফলন:
গড় ফলন বছরে গাছ প্রতি ৮ কেজি-র বেশী অথবা ১-১.৫ মেঃ টন প্রতি হেক্টরে।

রোগ ও পোকা:
পোকা
১) চা-মশা:
সক্রিয় থাকে অক্টোবর থেকে মার্চ, লাল বাদামী রংঙের পোকা গাছের কচি পাতায়, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে যায়। আক্রান্ত কচিপাতা এবং ফুল শুকিয়ে যায় এবং বাদামেও দাগ পড়ে।

২) খ্রিস্ঃ
দুই ধরণের পাতা এবং ফুল আক্রান্তকারী, এই পোকার আক্রমণের ফলে পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায়। বাদাম ছোট আকারের হয় এবং আপেলও ফেটে যায়।

৩) পাতা এবং ফুল মোড়ানো পোকা:
ডালার অগ্রভাগে সিল্ক এর মত মোড়ানো পাতা ও ফুল; এতে কিছু গুঁড়ো গুঁড়ো গাছের অংশ থাকে। এর আক্রমণের ফলে পাতা এবং ফুল শুকিয়ে যায়।

৪) পাতার সবুজ অংশ খাওয়া পোকা:
পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে, যার ফলে গোল গোল পোড়া দাগ দেখা যায় পাতাতে এবং পাতাটি মুড়িয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যায়।

প্রতিকার:
নীচে বিভিন্ন কীটনাশক ঔষধ দেওয়া হল, ঐগুলি ২% ইউরিয়া (২০ গ্রাম ইউরিয়া প্রতি লিটার জলে) এবং কীটনাশক ঔষধের সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন সময়ে স্প্রে করা দরকার।
কীটনাশক ঔষধ স্প্রে করার আগে নীচের বিষয়গুলিতে নজর দিতে হবে-
১) বাগানের জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে।
২) স্প্রে করতে হবে সকাল ১০টার মধ্যে এবং বিকাল ৩টার পরে।
৩) বাতাসের বিপক্ষে স্প্রে করা বাঞ্ছনীয় নয়।

৬) কান্ড এবং শিকড় ছিদ্রকারী পোকা:
বেশী আক্রান্ত হয় ১০-১২ বছরের বেশী গাছ। কীড়াগুলি কান্ডে এবং শিকড়ে সুড়ঙ্গ তৈরী করে। যার ফলে জাইলেম এবং ফ্লেয়েম কোষগুলির ক্ষতি হয়। গাছের পাতা হলুদ হতে থাকে এবং আক্রান্ত গাছের অংশ থেকে আঁঠালো রস দেখা মাত্রই প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিন।

প্রতিকার:
ক) সরু তার ঢুকিয়ে কীড়া মেরে ফেলুন।
খ) কারবারিল ৪ জি (দানাদার) ৭৫ গ্রাম/ গাছ; মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।
গ) গাছের গোঁড়াতে আলকাতরা এবং কেরোসিন মিশ্রণ ১:২ অনুপাতে প্রলেপ লাগাতে হবে।

৭) উই পোকা:
শিকড় এবং কান্ডে আক্রমণ করে।

প্রতিকার:
মাটিতে ক্লোরোপাইরিফস্ ৫ মিঃলিঃ/ লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করুন।

রোগ:
১) ধ্বসা রোগ: নারসারিতেই এই রোগ বেশী হয়। গোড়া এবং শিকড় পচে যায়।

প্রতিকার:
ক্যাপটান ১ গ্রাম / লিটার জলে গুলে স্প্রে।

২) ডাইবেক:
আক্রান্ত ডালাতে সাদা অথবা পিঙ্করঙের ছত্রাক দেখা যায়। পরে গাছের বাকল ফেটে যায় এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করে এবং ডালা শুকিয়ে যায়।

প্রতিকার:
ক) আক্রান্ত শাখার সঙ্গে কিছু রোগহীন শাখা কেটে ফেলুন।
খ) কাটা অংশে ১০ শতাংশ বোর্দো মলম লাগাবেন।
গ) ১ শতাংশ বোর্দো মিশ্রণ গাছে স্প্রে করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ