Advertisement

Responsive Advertisement

ত্রিপুরায় পেঁপে চাষের প্রকৌশল


পেঁপে (ক্যারিকা পাপায়া)

ত্রিপুরা রাজ্যে ফলের মধ্যে পেঁপে একটি জনপ্রিয় ফল। ইহা ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে চাষ হয়ে থাকে। পেঁপেকে পুষ্টিকর, অর্থকরী এবং গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি ফসল হিসাবে গণ্য করা হয়।

ত্রিপুরাতে পেঁপে সজ্জি ও পাকা ফল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভাইরাস এবং ছত্রাক জাতীয় রোগে সহজেই আক্রান্ত হয় বলে, খুব কম চাষীই পেঁপের চাষ করে। উপযুক্ত সময়ে রোপন, চারা তৈরী এবং বাগানকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিচর্যা করলে ঐ রোগগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সারা বছর ফসল পাওয়ার জন্য ইহাকে বাড়ীর বাগানে অনেকেই চাষ করে।

শ্রেণী: পেঁপে ক্যারিক্যাসি পরিবারভূক্ত।

জাতঃ
( ১) ওয়াশিংটন: ইহার পাতার কাণ্ডগুলি বেগুনী বর্ণের। ফলগুলি মধ্যম থেকে বড় আকৃতির। এক একটি ফলের ওজন প্রায় ২.৫ কে.জি.।
( ২) কুর্গ হনি ডিউ: ইহা বেঁটে, বেশী ফলন দেয়। ফলগুলি আয়তাকার। ইহা গাইনোডায়োসিয়াস গোত্র।
৩) পুসা ডুয়ার্ক: গাছগুলি বেটে এবং যেখানে বাতাসের গতিবেগ বেশী, ঐ সব অঞ্চলের জন্য উপযোগী। ইহা ডায়োসিয়াস গোত্র।
৪) পুসা ম্যাজিস্টিকঃ ফলগুলি মধ্যম আকৃতির, অন্যান্য পেঁপের জাতের তুলনায় বেশী দিনসংরক্ষণ করা যায়। ভাইরাস এবং নিমাটোডেরপ্রতিবন্ধক।
৫) পুসা নানহা: ইহা বেঁটে জাত এবং কিচেন গার্ডেনের জন্য উপযোগী।
৬) তাইওয়ান: ফলের মাংসগুলি রক্ত লালবর্ণ এবং সুস্বাদু। অন্যান্য জাতের মধ্যে সূর্য এবং কুর্গ হনি উল্লেখযোগ্য।
মাটি:
পেপে চাষের জন্য জলনিষ্কাশন যোগ্য উর্বর মাটি প্রয়োজন। বেলে দোআঁশ মাটি যেখানে pH ৬.৫ থেকে ৭ থাকে, সেখানে ফলন ভাল হয়।

আবহাওয়া:
পেঁপে উষ্ণ আদ্র আবহাওয়াতে ভাল হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ মিটার উঁচু পর্যন্ত ইহাকে চাষ করা যায়, কিন্তু তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। পেঁপে চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হল ২৫°C থেকে ৩০°C। গাছের বৃদ্ধি এবং ফলের পরিপক্কতা ব্যাহত হয়, যখন তাপমাত্রা ১০°C এর নীচে থাকে। ফুল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়, আবার ফলের পরিপক্কতার সময় ফলের মিষ্টত্ব বৃদ্ধি করে।

বংশবিস্তার:
সাধারণত পেঁপে বীজের মাধ্যমে (বংশবিস্তার) চাষ হয়ে থাকে। পেঁপের বীজ ৬০-৯০ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নতুন টাকা বীজে সারকোটেস্টা থাকার জন্য অঙ্কুরোদ্গম হয় না। তাই বীজকে কাঠের গুঁড়ো বা গোবরের ছাই দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে, ছায়া জায়গাতে শুকানো উচিত।

চারা তৈরী:
বীজতলাতে তৈরী চারা থেকে পলিথিন ব্যাগে তৈরী চারা মূল জমিতে রোপনের পর নষ্ট কম হয়। ২০ সেমি x ১৫ সে.মি. সাইজের পলিথিন ব্যাগে ১:১:১ অনুপাতে উপরের মাটি, গোবর এবং বালু মিশিয়ে, ১ সে.মি. গভীরতায় বীজ বোনা হয়। সাধারণতঃ বীজ বোনার পর ১০-২০ দিনের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়ে থাকে এবং ৪৫ থেকে ৬০ দিনের বয়সের চারাকে মূল জমিতে রোপন করা যায়।

চারা রোপনের সময়ঃ
যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত এবং ভাইরাসের সমস্যা বেশী থাকে, সেই সব অঞ্চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মূল জমিতে চারা রোপন করা হয়। টিলা জায়গাতে বর্ষার সময় চারা রোপন করা যায়।

চারা রোপন পদ্ধতি এবং ঘনত্বঃ
মূল জমিতে চারা রোপন করার জন্য ৪৫ সে.মি. × ৪৫ সে.মি. × ৪৫ সে.মি. সাইজের গর্ত করে প্রতি গর্তে ২০ কেজিঃ গোবর, ১ কেজি নিমকেকসহ মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। প্রতিটি গর্তে দুইটি চারা (ডায়োসিয়াস গোত্র) এবং একটি চারা (গাইনোডায়োসিয়াস গোত্র) লাগানোর পর ক্যাপ্টান মিশ্রিত (২ গ্রাম প্রতি লিটার) হালকা জল দেওয়া উচিত।
চারা রোপনের ঘনত্ব, জাত, জমির উর্বরতা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
লম্বাজাতের ক্ষেত্রে ২ মি. x ২ মি. = ২৫০০ চারা / হেঃ, বেটে জাতের ক্ষেত্রে ১৫ মিঃ ×১৫ মিঃ = ৪৪০০ চারা / হেঃ।

অপ্রয়োজনীয় গাছ অপসারণ:
ঠিকমত পরিচর্যা করলে পেঁপে গাছে ৪-৭ মাসেই ফুল আসে। ডায়োসিয়াস গোত্রের ক্ষেত্রে ফুল আসার পর প্রতি গর্তে একটি গাছ রেখে বাকীগুলিকে সরিয়ে ফেলা উচিত যাহাতে প্রতি ১০ টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ থাকে।

সার প্রয়োগ:
পেঁপে তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি হয়, তার জন্য খাদ্য যোগান দরকার। নিম্নলিখিত সারগুলি প্রতি বৎসর প্রতি গাছের জন্য -
i) গোবর জাতীয় সার - ১৫ কে.জি.
ii) নিম কেক - ১ কে.জি.
iii) ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম
সিঙ্গল সুপার ফসফেট ১৪০০ গ্রাম।
পটাস - ৭০০ গ্রাম।

অজৈব সারগুলি প্রতি দুই মাস অন্তর শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধি এবং ফুল আসার সময় ছয় বারে দেওয়া প্রয়োজন। শাখা প্রশাখা এবং ফুল আসার সময় এক বা দুইবার ZnSo4 (@ ৫ গ্রাম প্রতি লিটার জল) এবং বোরাক্স (@১ গ্রাম প্রতি লিটার জল) স্প্রে করলে ফলের সাইজ ভাল হয়।

জল সেচ:
প্রথম বছর রক্ষণকারী জলসেচের প্রয়োজন। দ্বিতীয় বৎসর থেকে শীতকালে ১০ দিন অন্তর এবং গ্রীষ্মকালে ৫ দিন অন্তর জলসেচের প্রয়োজন।

বাগান পরিচর্যা:
১) আগাছা দমন: আগাছা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, কারণ তারা রোগের বাহক এবং পোকার আশ্রয়দানকারী।
২) কুঁড়ি অপসারণ: মূল কান্ডের কাছে ছোট কান্ড বা কুঁড়িকে সরিয়ে ফেলা উচিত, কারণ এরা শুধু পুষ্টি শোষণ করে।
৩) পুরোনো পাতা: পুরোনো শুকনো পাতাকে সরানো উচিত।
৪) ফল অপসারণ: একই পেডিসেলে ২ বা ৩টি ফল ধরলে, শুধু একটি ফল রেখে, বাকীগুলি সরানো উচিত।
৫) সাহায্যকারী: গাছে বেশী ফল ধরলে সাহায্যকারী হিসাবে ঠেকা দেওয়া প্রয়োজন।

উৎপাদনক্ষম জীবন ও ফলন:
জাত এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে একটি পরিপক্ক ফলে পরিণত হতে সময় নেয় প্রায় ১৩০-১৬৫ দিন। পেঁপের লাভজনক উৎপাদনক্ষম প্রায় তিন বৎসর, এর পরে গাছ লম্বা হতে থাকে। ফলন নির্ভর করে জাত, মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া এবং বাগানের পরিচর্যার উপর। প্রতিটি ফলের মরশুমে এক একটি গাছে প্রায় ২০-৪০ টি ফল ধরে যার গড়পড়তা ওজন হয় ৪০-৭৫ কে.জি.। এক একটি ফলের মরশুমে প্রায় ৬০-৭৫ মে. টন প্রতি হেঃ ফল আশা করা যায়।

রোগ পোকা:
১। ঢলে পড়া রোগ (C.O: Pythium aphanidermatum এবং phytophthora palmivora)
বীজতলাতে চারাগুলি পচে যায় বা ঢলে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ: বীজ বোনার আগে বীজকে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি দিয়ে (৩-৪ গ্রাম / কেজি বীজ) অথবা ক্যাপ্টান (৩-৪ গ্রাম / কেজি বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। রিডোমিল বা কার্জেট-এম-৮ (১ মি.লি. / লি. জল) বা ব্যাভিস্টিন (২ গ্রাম / লিঃ জল) দিয়ে বীজতলা বা মাটি ভিজিয়ে দেওয়া।

২। কান্ড বা গোঁড়া পচা রোগঃ (C. O. Pythium aphanidermatum, Phytophthora patasitica)
জমিতে জল জমে থাকা এবং খারাপ নিষ্কাশন-এর জন্য দায়ী। পাতাগুলি নুয়ে পড়ে এবং পচা গাছগুলি শেষ পর্যন্ত মাটিতে পড়ে যায়।

দমন ব্যবস্থা: থিরাম বা ক্যাপ্টাম (২ গ্রাম / কে.জি. বীজ) দিয়ে বীজ শোধন। চারা লাগানোর সময় মূলের চারিদিকে গোবরের সাথে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি (১৫ গ্রাম / প্রতি চারা) প্রয়োগ করতে হবে। রিডোমিল mz বা কার্বেনডাজিম (১ গ্রাম / প্রতি লিঃ জল) বা ব্লাইটক্স (৩ গ্রাম/প্রতি লিঃ জল) অথবা (বরডক্স) মিশ্রণ (১%) দিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর মাটি ভিজিয়ে দিলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

৩। ক্ষত রোগঃ (C.O. - Colletotrichum spp.) এটিও একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। ইহা পাতা, ফুলে এবং ফলে হতে পারে, যার ফলে এইগুলি ঝরে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ: কার্বেনডাজিম (১ গ্রাম/প্রতি লিঃ জল) বা ডাইফল্টন (২গ্রাম / প্রতি লিঃ জল) স্প্রে করতে হবে।
 ৪। মোজেইক (রিং স্পট ভাইরাস): উপরের পাতাগুলি হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং তৈলাক্ত দাগ দেখা যায়।

নিয়ন্ত্রণ: চারা তৈরীর সময় চারাকে নাইলনের মশারী দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। ভাইরাসের বাহককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোগর (২ মিলি/প্রতি লিঃ জল) বা মেটাসিসটক্স (২ মিলি / প্রতি লিঃ জল) দিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর স্প্রে করা দরকার।

৫। পাতা কুঁকড়ানো: রোগটির বাহক হল সাদা মাছি। পাতাগুলি কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতার শিরাগুলি স্পষ্ট এবং গাঢ়ত্ব হয়। আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

নিয়ন্ত্রণ: রোগের বাহককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মেটাসিসটক্স (২ মি.লি. প্রতি লিঃ জল) বা নুভাক্রন (০.৫ মিলি/ লিঃ জল) বা কনফিডর (১.৫ মিলি / লি. জল) স্প্রে করা দরকার।

৬) লিফ ব্লাইটস: (C. O. Corynespora cassiicola) পাতাগুলি প্রথমে বর্ণহীন হয় এবং সেগুলি পাতার সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রণ: এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ডাইথেন M-45 স্প্রে করা দরকার।

পোকা:
১।অ্যাফিডস: ভাইরাস রোগের বাহক নিয়ন্ত্রনের জন্য উপরিউক্ত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
২। লাল মাকড: লাল মাকড় ফলে বিভিন্ন দাগ তৈরী করে, যার জন্য ফলের বাজার মূল্য কমে যায়।

নিয়ন্ত্রণ: ফসফামিডন (০.৫ মিলি/লিঃ জল) বা ডাইকোফল (২ মিলি/লি জল) দিয়ে স্প্রে করা দরকার।

৩। নিমাটোড (Meloidogyne Sp.) নিমাটোড আক্রান্ত গাছগুলির পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পরে পাতা এবং ফল ঝরে পড়ে। মূলে ছোট ছোট গোলাকৃতি আকার দেখা যায়।

নিয়ন্ত্রণ:
১। চারা লাগানোর আগে প্রতি গর্তে নিমকেক ব্যবহার করতে হবে।
২। কার্বোফুরান ৩-জি (২০ কেজি / প্রতি হেঃ) জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ