মানুষের কল্পনায় মহাকাশ মানেই রহস্য আর স্বপ্নের এক অনন্ত দিগন্ত। সেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে স্যাটেলাইট। ইন্টারনেট থেকে শুরু করে আবহাওয়া পূর্বাভাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা সামরিক কৌশল—সবকিছুই আজ নির্ভর করছে এই ক্ষুদ্র অথচ অমূল্য কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর উপর। তবে এই অসাধারণ প্রযুক্তির পাশাপাশি বাড়ছে এক অস্বস্তিকর সত্য, মহাকাশ ক্রমেই ভরে উঠছে অব্যবহারযোগ্য ধাতব টুকরো আর ভগ্ন স্যাটেলাইটে—যেন আকাশের বুকে জমে উঠছে এক অদৃশ্য আবর্জনার স্তূপ।
২০২৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর কক্ষপথে বর্তমানে ঘুরছে প্রায় পনেরো হাজার স্যাটেলাইট। এর মধ্যে সক্রিয় অবস্থায় আছে এগারো হাজার সাতশো’র বেশি, বাকিগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে রয়েছে। এই নিষ্ক্রিয় স্যাটেলাইটগুলো কেবল অচল বস্তু নয়, বরং সময়ে সময়ে একেকটি ভাসমান বিপদের কারণ হয়ে উঠছে। কারণ এগুলো যেকোনো মুহূর্তে অন্য স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে, আর সেই সংঘর্ষ থেকে জন্ম নিতে পারে আরও হাজারো টুকরো।
ভারত এই প্রতিযোগিতায় আজ এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ইসরোর হাত ধরে দেশটির নিজস্ব প্রায় অর্ধশত সক্রিয় স্যাটেলাইট এখন আকাশে কাজ করছে। শুধু তাই নয়, অন্য দেশেরও শত শত স্যাটেলাইট ভারতই কক্ষপথে পৌঁছে দিয়েছে। চন্দ্রযান বা আদিত্য-এল১-এর মতো ডিপ-স্পেস অভিযানের কারণে ভারতের নাম আজ গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে মহাকাশ গবেষণার মানচিত্রে।
তবে মহাকাশের সত্যিকারের সম্রাট বলতে গেলে একজনই—এলন মাস্ক। তাঁর প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প একাই পৃথিবীর সক্রিয় স্যাটেলাইটের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দখল করে ফেলেছে। সাত হাজারের বেশি স্যাটেলাইট নিয়ে এই প্রকল্প পৃথিবীর প্রত্যন্ত প্রান্তে ইন্টারনেট পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ এর পাশাপাশি মহাকাশের ভিড় বাড়িয়ে তুলছে আমেরিকার এই ব্যবসায়ী।
মহাকাশে আবর্জনার উৎপত্তি শুধু একক কারও দোষ নয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত—সব দেশই অকার্যকর স্যাটেলাইট আর রকেটের অবশিষ্টাংশ কক্ষপথে ফেলে রেখেছে। এই ধাতব টুকরোসমূহ ছুটছে ঘণ্টায় প্রায় সাতাশ হাজার কিলোমিটার গতিতে। এত দ্রুতগতির ক্ষুদ্র টুকরোও কার্যত চলন্ত গুলির মতো, যা অন্য স্যাটেলাইট বা মহাকাশযানের জন্য প্রাণঘাতী বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই ভাঙন চেইন রিঅ্যাকশনের মতো চলতে থাকে তবে একসময় পুরো কক্ষপথ প্রায় অচল হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কার নামই কেসলার সিনড্রোম।
সমস্যা বোঝা যাচ্ছে বলেই সমাধানের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ঘোষণা করেছে ‘জিরো ডেব্রিস চার্টার’, যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে আর নতুন কোনো আবর্জনা কক্ষপথে না ফেলার। কেউ জাল ব্যবহার করে পুরোনো স্যাটেলাইট নামানোর পরিকল্পনা করছে, কেউ আবার এমন প্রযুক্তি তৈরি করছে যাতে নির্দিষ্ট সময় পর স্যাটেলাইট নিজেই বায়ুমণ্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—যখন প্রতিদিন আকাশে নতুন স্যাটেলাইট উঠছে, তখন কি এই উদ্যোগ যথেষ্ট হবে?
মানবসভ্যতার জন্য স্যাটেলাইট নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। কিন্তু একই সঙ্গে তা যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জমা হতে থাকে তবে সেই আশীর্বাদই পরিণত হতে পারে অভিশাপে। মহাকাশ আমাদের ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক, তাই এটিকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদেরই। পৃথিবীর মতো মহাকাশকেও যদি আবর্জনার স্তূপ বানিয়ে তুলি, তবে একদিন আকাশের দিকেই তাকানো কঠিন হয়ে যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ