Advertisement

Responsive Advertisement

হুমায়ূন: ইতিহাসের ছায়াতলে এক সংস্কৃতিপ্রেমী সম্রাট ও তার স্মৃতিসৌধ




ভারতের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তার যতটা বর্ণময়, ততটাই জটিল। এই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম— সম্রাট হুমায়ূন। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট, প্রতিষ্ঠাতা বাবর-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র। যদিও ইতিহাস তাকে যুদ্ধজয়ী কিংবা কৌশলী শাসক হিসেবে নয়, বরং এক সংস্কৃতিপ্রেমী, বিদ্যাবোদ্ধা এবং দুর্ভাগ্যপীড়িত সম্রাট হিসেবে মনে রেখেছে, তবুও তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে — বিশেষ করে মৃত্যুর পর নির্মিত তার চিরস্থায়ী আবাস 'হুমায়ুনের সমাধি'-র জন্য।
হুমায়ূনের শাসনকাল মোটামুটি দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে তিনি ১৫৩০ সালে বাবরের মৃত্যুর পর রাজ্যভার গ্রহণ করেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং শের শাহ সূরির বিদ্রোহের মুখে তাকে রাজ্য হারাতে হয় মাত্র দশ বছরের মাথায়। এরপর এক দীর্ঘ নির্বাসনের সময় পারস্য (বর্তমান ইরান)-এ কাটান, যেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় পান এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। সেই অভিজ্ঞতা তাকে আরও সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলে। পরে তিনি ১৫৫৫ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং পুনরায় দিল্লি ও আগ্রা দখল করে মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাত্র কয়েক মাস পরই ১৫৫৬ সালে এক লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়।
শাসক হিসেবে হুমায়ূনের বিচিত্র ব্যক্তিত্ব ছিল। তিনি ছিলেন সৌম্য স্বভাবের, জ্যোতিষশাস্ত্র ও গ্রন্থ পাঠে গভীরভাবে আগ্রহী। যুদ্ধ ও প্রশাসনে হয়তো বাবরের মতো দক্ষতা দেখাতে পারেননি, তবে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ মুঘল সভ্যতার পরবর্তী ধাপের ভিত গড়ে দেয়। তিনি পাণ্ডিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, পারস্যের শিল্পচর্চা ও সাহিত্যের অনেক দিক মুঘল ভারতে প্রথমবারের মতো আনেন। বলা চলে, আকবরের মহান সাম্রাজ্য গঠনের পেছনে হুমায়ূনের অনুকূল সাংস্কৃতিক বীজ বপন করা ছিল একটি নিঃশব্দ অবদান।
তাঁর মৃত্যুর পর ইতিহাস তাকে নতুনভাবে মনে রাখে— সেই স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত 'হুমায়ুনের সমাধি'। এই সমাধি শুধু একজন সম্রাটের শেষ ঠিকানা নয়, বরং উপমহাদেশে মুঘল স্থাপত্যের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা। এটি নির্মাণ করেন তার স্ত্রী হামিদা বানু বেগম, প্রায় ১৫ লাখ তৎকালীন টাকা ব্যয়ে। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৫৬৫ সালে এবং সমাপ্ত হয় ১৫৭২ সালে। বলা হয়ে থাকে, এটি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছিল এবং হাজার হাজার দক্ষ কারিগর ও শ্রমিক এতে অংশ নেন। এটি ছিল উপমহাদেশে প্রথম মুঘল “বাগান-সমাধি” — চারদিকে সবুজ বাগান, জলের ধারা ও মার্বেল-লাল পাথরের অপূর্ব সমন্বয়।
হুমায়ুনের সমাধি আজ শুধু স্থাপত্যের নিদর্শন নয়, এটি ইতিহাস, স্মৃতি এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের বহনকারী। ১৯৯৩ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের মর্যাদা পায়। প্রায় ২৭ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই সমাধি চত্বর শুধু হুমায়ুনকেই ধারণ করে না, বরং এখানেই শায়িত আছেন প্রায় ১৫০ জন রাজবংশীয় — যাদের মধ্যে রয়েছেন দারা শিকোহ, রফি উদ্দৌলা, আলমগীর II, জাহানদার শাহ প্রমুখ।
এই সমাধি দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন ভারত ও বহির্বিশ্ব থেকে। এটি মুঘল স্থাপত্যের সেই সূচনা বিন্দু, যার পরে এসেছে তাজমহল। হুমায়ুনের সমাধি একটি নিঃশব্দ শিল্পকাব্য, যেখানে ইতিহাস স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল বালি পাথর ও সাদা মার্বেলের বাঁকে বাঁকে।
সম্রাট হুমায়ূন হয়তো রাজনৈতিকভাবে শক্তিমান ছিলেন না, তবে তার অবদান অন্য উচ্চতায়। তিনি জয় করতে পারেননি যতটা, ঠিক ততটাই জয় করেছেন হৃদয় — সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসায়, জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধায় এবং মৃত্যুর পর নির্মিত অপূর্ব এক স্মৃতিস্তম্ভে, যা চিরকালের জন্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ইতিহাস শুধু বিজয়ীর নয়, সংস্কৃতিপ্রেমীরও।
ইতিহাস অনুযায়ী মোগল সম্রাট হুমায়ুন (শাসনকাল: ১৫৩০–১৫৪০ এবং পুনরায় ১৫৫৫–১৫৫৬) হিন্দুদের উপর কোনও বড় মাত্রার ধর্মীয় নির্যাতন চালাননি। বরং, তিনি তুলনামূলকভাবে সহনশীল ও উদার মনোভাবাপন্ন শাসক ছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ