Advertisement

Responsive Advertisement

শ্মশানের দর্শন হয়তো চেতনার জন্ম দিতে পারে!


 

                             জম্পুই পাহাড়ের ছবি 



মানব জীবনের অন্যতম অপরিহার্য সত্য হল — মৃত্যু। আমরা প্রতিদিন জন্ম, জীবনের আনন্দ, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আবেগে ব্যস্ত থাকি। কেউ হয়তো গায়ের জোরে চেঁচিয়ে তাকে অন্য ১০ জনের সামনে সত্য বানিয়ে দিতে পারে, আবার অন্য মানুষকে মিথ্যা প্রতারক বানিয়েও দিতে পারে। কেউ হয়তো মুখের মিষ্টি ভাষা কথা বলে নিজের যতটুকু নয় তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে প্রমাণ করছে। আধুনিক এই ইঁদুর দৌড়ের যুগে নিজেকে বড় দেখানোই আসল ব্যাপার, যার সাহায্যে, যার অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষ বড় হয়েছে তাকেই নির্দ্বিতায় অস্বীকার করছে, মিথ্যা কথা পাহাড় তৈরি করতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ হচ্ছে না অনেকের আজকাল। কিন্তু একবার হলেও নিজের এইসব চালাকির অস্থিরতাকে ছেড়ে, জীবনের চরম সত্য জানতে অন্তত একবার শ্মশানে যাওয়া উচিৎ, কঠিন বাস্তব উপলব্ধির অন্যতম পথ হচ্ছে এটি। শ্মশানে গেলে হয়তো চতুর এই মানুষগুলির চিন্তাভাবনায় কিছুটা আগাম আসতে পারে।
শ্মশানে যাওয়া মানে কেবল মৃতদেহ দেখার অভিজ্ঞতা নয়। এটি নিজেকে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি নীরব, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন প্রক্রিয়া। মোবাইল, সঙ্গী, পরিবারের তাড়না—সব কিছু এ বার বাদ। শ্মশানে সঙ্গে থাকবে শুধুই একাকীত্ব। নিঃসঙ্গ অবস্থায় দাঁড়ালে চোখের সামনে ভেসে আসে মৃতদেহ, যার একদিন একটি নাম অবশ্যই ছিল, কিন্তু এখন সে শুধু একটি দেহমাত্র। সারাজীবন দায়িত্ব ও কর্তব্যে আবদ্ধ কাঁধ আজ মুক্ত। কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো নিয়ম নেই।
এই মূহূর্তে জীবন ও মৃত্যুর মেলবন্ধন চোখের সামনে স্পষ্ট। নিশ্চিত এই পরিস্থিতিতে লোভে অন্ধ মানুষগুলির মধ্যে বিবেকের দংশন হবে। এমন কি ভালোবাসার মানুষকে চিরদিন ভালো রাখার অপ্রয়োজনীয় প্রতিজ্ঞা, সোহাগী আলিঙ্গন, রোমকূপে উত্তেজনা—সবই নিঃশেষ হয়ে যায়। সাতরঙের জীবনের ক্যানভাসে আজ একটাই রং  শুধু কালো।
যখন চোখ অগ্নির দিকে চলে যায়, তখন দেখা যায় অনন্তকাল জ্বলছে লেলিহান আগুনে। এখানে পাপ বা পুণ্য, বিচার বা ন্যায় নেই। শুধুই মৃত্যুর নীরব, সর্বগ্রাসী শক্তি, যা কোনো মানুষের উপর সমান অধিকার বিস্তার করে। পরিবারের তাড়নায় দ্রুত চুল্লিতে প্রবেশ করা এই অস্তিত্বকে মুক্ত করে, মুছে দেয় জীবনের লালসা, প্রেমের মাধুর্য, অপমান, সন্তানের চিন্তা, প্রতিশ্রুতি, মানবিক প্রত্যাশা—সব।
এরপর আসে জল। নদীর প্রবাহে, সমুদ্রের বিস্তৃতিতে সবশেষ শিখা, নিঃশেষ নাভিমূল ভেসে যায়। মৃত্যুর সত্যকে এড়িয়ে পালানোর কোনো উপায় নেই। জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা, অহংকার, অব্যক্ত আবেগ—সবকিছুকে সঙ্গে নিয়ে এই অন্তিম যাত্রা নিশ্চিতভাবে ঘটে।
শ্মশান আমাদের শিখায় নিজের অন্তিম সত্য বুঝতে। এটি একটি নীরব শিক্ষা, যা জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করায়। মাসে অন্তত একবার শ্মশানে যাওয়া মানে নিজেকে মৃত্যুর সঙ্গী করে তোলা, ভয়মুক্তভাবে, একাকী। এই অভিজ্ঞতা জীবনকে আরও স্পষ্ট করে, আমাদের শেখায় — যে মৃত্যু অনিবার্য, তাকে ভয় বা ব্যর্থতার ছায়ায় আড়াল করা সম্ভব নয়।
শুধু একা, নির্ভয়ে, অন্তরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আমরা জীবনের প্রকৃত রঙ ও মৃত্যুর অনন্ত সত্য উপলব্ধি করতে পারি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ