আসামের সংগীতজগৎ এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে যে নাম আজীবন অমলিন হয়ে থাকবে, তিনি জুবিন গর্গ। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, অভিনেতা, কবি—সংগীতের প্রতিটি ধারায় তিনি নিজের সৃজনশীল ছাপ রেখে গেছেন। হঠাৎ মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিলেও, তাঁর গাওয়া গান, সুরারোপিত সুর আর অভিনীত চরিত্র আজও মানুষের আবেগে অম্লান।
১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর আসামে জন্ম নেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন। বাবা ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক, মা-ও ছিলেন গানপ্রিয়। স্বভাবতই ছোটবেলা থেকেই সুরের জগতে বেড়ে ওঠা জুবিন খুব অল্প বয়সেই গানকে জীবনের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। কৈশোরেই সংগীত চর্চা শুরু করেন, আর তরুণ বয়সেই আসামি সংগীতের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে, ১৯৯২ সালে, প্রকাশ করেন নিজের প্রথম অ্যালবাম অনামিকা। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁর দুর্দান্ত পথচলা। পরবর্তীতে ‘মায়া’, ‘আশা’, ‘পাখি’র মতো একের পর এক জনপ্রিয় অ্যালবাম তাঁকে এনে দেয় আঞ্চলিক গণ্ডির বাইরের পরিচিতি। কিন্তু জুবিনকে জাতীয়পরিসরে পরিচিত করে তোলে বলিউড। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গ্যাংস্টার সিনেমার গান ইয়া আলি তাকে সারাদেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে দেয়। সেই এক গানই যেন তাঁর কণ্ঠের জাদুকে পৌঁছে দেয় কোটি কোটি মানুষের কাছে। যদিও এর মধ্যেই তিনি আসামি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ভোজপুরি থেকে শুরু করে প্রায় চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় গান গেয়ে নিজের বহুমুখী প্রতিভা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে জুবিন শুধু গায়ক নন, ছিলেন সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা ও পরিচালকও। চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি যেমন দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে, তেমনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ভিন্ন স্বাদের সুর। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী ছিলেন আসামের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর গান মানে ছিল মানুষের মনের সঙ্গে সুরের অদ্ভুত মেলবন্ধন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ। স্ত্রী গরীমা সৈকিয়া গর্গকে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল শিল্প ও ভালোবাসায় ভরা। একদিকে তিনি ছিলেন মঞ্চের নায়ক, অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনে বিনয়ী এবং বন্ধুপ্রিয়। সমাজের নানা কর্মকাণ্ডেও তাঁর সরব উপস্থিতি দেখা যেত। গান থেকে পাওয়া জনপ্রিয়তাকে তিনি ব্যবহার করেছেন সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও।
কিন্তু ২০২৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতটে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন জুবিন। দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও ফিরিয়ে আনা যায়নি। মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর জীবন থেমে যায় অকস্মাৎ। প্রথমদিকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডুবে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও পরবর্তীতে জানা যায়, ডাইভের সময় তিনি আকস্মিকভাবে স্ট্রোক বা সিজারের শিকার হয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হয় শ্বাসপ্রশ্বাসের জটিলতা, আর শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটে।
এই আকস্মিক প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে আসে আসামসহ সমগ্র সংগীতাঙ্গনে। গৌহাটিতে তাঁর মরদেহ পৌঁছালে হাজার হাজার মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন। রাজ্য সরকার ঘোষণা করে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সেদিন আক্ষরিক অর্থেই থমকে গিয়েছিল আসাম। মানুষের চোখে জল, মুখে একটাই প্রশ্ন—এভাবে কি চলে যায় কোনো শিল্পী?
জুবিন গর্গ ছিলেন না শুধু একজন গায়ক, তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের আবেগ, প্রতিবাদের প্রতীক, ভালোবাসার অন্য নাম। তাঁর গান যেমন প্রেমের কথা বলেছে, তেমনি সমাজের কথাও তুলে ধরেছে। তাঁর কণ্ঠে ছিল সহজাত মায়া, যা শ্রোতাকে ছুঁয়ে যেত। তাঁর অকাল প্রয়াণ শুধু একটি সংগীত জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এক বিশাল সাংস্কৃতিক শূন্যতার নাম।
আজ যখন তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, দেখি এক অনন্য শিল্পীকে, যিনি সুর দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলেন ভালোবাসা, আশা আর স্বপ্নের বন্ধন। তিনি আর নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া গান, তাঁর কণ্ঠের মায়াজাল এবং তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর পরেও জুবিন গর্গ আমাদের কাছে শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি এক অমর সুরের প্রতীক।
0 মন্তব্যসমূহ